ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে আলোকিত হয়ে ওঠার দিন। কারণ আজ ফুটবল ঈশ্বরখ্যাত ডিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনার জন্মদিন। তিনি শুধু একজন ফুটবলার নন; তিনি ছিলেন সংগ্রামী চেতনার এক প্রতীক। যার প্রতিটি স্পর্শে ফুটবল মাঠ রঙিন হয়ে উঠত, আর প্রতিটি পদক্ষেপে আঁকা হতো মুক্তির এক নতুন ছক। যিনি চে গুয়েভরার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বেছে নিয়েছিলেন শোষিতের পক্ষে দাঁড়ানোর পথ। যার বন্ধু ছিলেন কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর পাড়ি জমিয়েছিলেন না ফেরার দেশে। আজ ৬৪তম জন্মদিনে তাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে ফুটবল আর বিপ্লব যেন মিলেমিশে এক হয়ে যায়।
ম্যারাডোনা যদি ফুটবলার না হতেন, তবে হয়তো হয়ে উঠতেন এক আগুনে বামপন্থী বিপ্লবী। আর্জেন্টিনার বঞ্চিতদের মধ্য থেকে উঠে আসা এই ক্ষণজন্মা নক্ষত্র শৈশবেই দেখেছিলেন শোষণ ও অবহেলা, যার কারণে তার মনে গেঁথে গিয়েছিল প্রতিরোধের বীজ। চে গুয়েভরা তার কাছে ছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস; চের আদর্শ বুকে লালন করে তার বাম হাতে তিনি খোদাই করেছিলেন চে-র মুখাবয়ব। যেন প্রতিটি শ্বাসে শ্বাসে সেই বিপ্লবীর চেতনা লালন করতেন তিনি।
ম্যারাডোনা যেন তার প্রতিটি গোলের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছিলেন মানুষ হয়ে ওঠার নতুন সংজ্ঞা। উরুগুয়ের বিখ্যাত সাহিত্যিক এদুয়ার্দো গ্যালানো তাকে নিয়ে লিখেছেন, ‘ম্যারাডোনা ছিল ফুটবলের সেই বিদ্রোহী কবি, যিনি প্রতিটি পায়ে লিখেছিলেন মুক্তির এক অমর কাব্য।’
ফুটবলের মাঠে ম্যারাডোনার উত্থান ছিল মহাকাব্যিক। ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপ যেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপাখ্যান। সেই কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ‘হ্যান্ড অফ গড’ গোলটি তার বিদ্রোহী চেতনার বহিঃপ্রকাশ, আর তার পরপরই করা ‘গোল অফ দ্য সেঞ্চুরি’ ছিল এক শিল্পীর নিজেকে প্রমাণের অসাধারণ দৃষ্টান্ত। এই গোলের মাধ্যমেই তিনি ফুটবলপ্রেমীদের মনে জায়গা করে নেন চিরকালের জন্য। ফুটবল কিংবদন্তি না হয়েও যদি কেউ কখনো শিল্পের এতটা উৎকর্ষ ফুটবলের মাঠে দেখিয়েছেন, তবে তিনি নিঃসন্দেহে ম্যারাডোনা।
গ্যালানো তাই তাকে তাকে নিয়ে আরও লিখেছিলেন, ‘ম্যারাডোনা প্রথাগত নিয়মের বাইরে গিয়ে খেলাটিকে শিল্পের স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। তার প্রতিটি স্পর্শ ছিল যেমন নাটকীয়, তেমনি বিপ্লবী। ফুটবল মাঠে তার প্রতিটি মুহূর্ত ছিল দর্শকদের জন্য এক উদযাপন।’
তার জীবনে আরেক প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল গভীর আর শ্রদ্ধার—যেন একই মনোভাবের দুই বিপরীত প্রান্তের সংযোগ। হাভানার আলোছায়ায় গড়ে উঠেছিল এক অদ্ভুত বন্ধন, যা ফুটবল মাঠ পেরিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ভাষা হয়ে উঠেছিল। কাস্ত্রোর কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন এক আস্থার ছায়া, যা তাকে নতুন এক জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ করেছিল। হাভানায় কাস্ত্রোর সঙ্গে কাটানো দিনগুলো তাকে শক্তি আর সাহস জুগিয়েছিল—তার জীবনের অন্ধকার সময়গুলোতে তিনি পেয়েছিলেন এই বন্ধুর সহায়তা। ফিদেল ছিলেন তার জন্য পিতৃসম, তাদের সম্পর্কটি ম্যারাডোনার জীবনে গভীর ছাপ ফেলেছিল।
সেই ছায়া পেয়েই ম্যারাডোনা নিজেকে কেবল ফুটবলেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি ফুটবলকে এক সামাজিক আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। তার ব্যক্তিগত জীবন, রাজনৈতিক মতবাদ এবং ফুটবল দক্ষতার মিশ্রণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এমন একজন, যাকে যুগ যুগ ধরে স্মরণ করা হবে। বিখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক হোর্হে ভালদানো লিখেছিলেন, ‘ডিয়েগো ছিল সেই বিস্ময়, যার মধ্যে প্রতিটি মানুষের আশা ও স্বপ্ন মিশে থাকে। তার প্রতিটি গোল, প্রতিটি হাসি যেন এই জগতের বঞ্চিতদের জন্য এক বিজয়ী মুহূর্ত হয়ে ওঠে।
ম্যারাডোনা তার প্রতিটি পদক্ষেপে দেখিয়েছেন যে ফুটবল কেবল খেলার জন্য নয়, এটি হতে পারে প্রতিরোধ ও পরিবর্তনের শক্তি।
ম্যারাডোনা ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন অনন্য হয়ে। তার জীবন একটি নাটক, যেখানে প্রতিটি দৃশ্যে ছিল সংঘর্ষ আর এক চিরন্তন ভালোবাসায় মোড়ানো। মাঠের বাইরেও তার কণ্ঠ, তার বিদ্রোহী মানসিকতা ফুটবল ছাড়িয়ে গিয়ে তাকে করে তুলেছে এক বিপ্লবের প্রতীক। তার জীবনকে ঘিরে এমন অনেক লোককাহিনি সৃষ্টি হয়েছে, যা কেবল তাকে ঘিরেই সম্ভব। এই কাহিনিগুলো প্রমাণ করে, ম্যারাডোনা মানুষের চোখের সামনে ছিলেন এক জীবন্ত কাব্য, যেখানে তার পা দিয়ে লেখা প্রতিটি শব্দ ছিল এক বিপ্লবী প্রতিচ্ছবি।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা কেবল একজন ফুটবল নায়কই না; তিনি বিদ্রোহী, এক অগ্নিমন্ত্র। তার প্রতিটি গৌরবের মুহূর্ত যেন ভাস্বর হয়ে আছে ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ের মণিকোঠায়।