বেড়া-সাঁথিয়ায় আতঙ্কের নাম ছিল টুকু-রঞ্জন
এমপি-মন্ত্রীর পদ আলাদিনের চেরাগের মতো বদলে দিয়েছে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও পাবনা-১ আসনের সাবেক এমপি শামসুল হক টুকু এবং তার পরিবারের ভাগ্য। নিয়োগ বাণিজ্য, সরকারি-বেসরকারি জমি দখল, অবৈধ বালু ব্যবসা, হাট ও নৌবন্দর দখল করে কামিয়েছেন হাজার কোটি টাকা। সরকার পতনের পর শামসুল হক টুকু গ্রেপ্তার হলেও বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন তার ছেলে বেড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র আসিফ শামস রঞ্জন।
হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে বেড়া উপজেলায় শামসুল হক টুকুর কোনো বাড়ি ছিল না। দুই ছেলে ও তাদের স্ত্রীদের ছিল না জমিজমা। মন্ত্রী হওয়ার পর কয়েক মাসের মধ্যেই বেড়ার বৃশালিখায় কয়েক কোটি টাকায় নির্মাণ করেন সুবিশাল ডুপ্লেক্স বাড়ি। অনিয়ম-দুর্নীতির অবৈধ অর্থে স্ত্রী লুৎফুন্নেছা, ছেলে আসিফ, নাসিফ ও ছেলের বউ মুসলিমা বনির নামে খোলা হয় কয়েকটি কোম্পানি, বিভিন্ন মৌজায় কেনা হয় কয়েকশ বিঘার ওপর জমি। অভিযোগ রয়েছে, লন্ডনে হোমওয়ার্ড প্রপার্টি, হলিডে অ্যাপার্টমেন্ট, আশনা এন্টারপ্রাইজসহ অন্তত ছয়টি কোম্পানির নামে হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন টুকু-পুত্র রঞ্জন।
সরকার পদত্যাগের পর বিক্ষুব্ধ জনতা টুকুর বেড়া পৌরসভার বৃশালিখার বাড়ি ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ, এমনকি বাড়ির দরজা-জানালা ভেঙে মালপত্র লুটপাট করে নিয়ে যায়। বাড়ির প্রাচীরের ইটও খুলে নিয়ে গেছে। বর্তমানে সে বাড়িটি কৌতূহলী মানুষের খোরাক মেটাচ্ছে। প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে বাড়িটি দেখতে ভিড় জমাচ্ছে মানুষ।
হাসিনার সরকার পতনকালে শামসুল হক টুকুর বাড়ির সামনে ইছামতী নদী দখল করে বালু দিয়ে ভরাট করে সুইমিংপুল বানানোর কাজ চলমান ছিল। তিনি দখলে নিয়েছিলেন বেড়া বৃশালিখা কোল ঘাট (নৌবন্দর)। বেড়ার পোর্ট এলাকায় থানার পাশে হুড়াসাগর নদী থেকে কোটি কোটি টাকার বালু উত্তোলন এবং হুড়াসাগর নদীর পাশে প্রায় দুই একর জায়গা দখল করে বালু উত্তোলন করে রেখেছেন টুকু ও তার পরিবার। পৌর এলাকার পায়না মহল্লায় যমুনা নদীর তীরে নদীসহ ব্যক্তি মালিকানাধীন অর্ধশতাধিক জমি দখলে নিয়েছিলেন।
এলাকাবাসী জানান, টুকুর ছেলে বেড়া পৌরসভার মেয়র হওয়ার পর এমন কোনো অবৈধ কাজ নেই, যা তিনি করতেন না। পৌরসভার ৮০ টাকার পানির বিল ২৫০ টাকায় নির্ধারণ করেন। ট্যাক্স হয় তিন থেকে বিশ গুণ। করমজা চতুর হাটে সরকারি জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণ করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অগ্রিম নেওয়া হতো লাখ লাখ টাকা। বেড়া পৌরসভাকে পরিষ্কার রাখার অঙ্গীকার নিয়ে প্রতিটি বাসাবাড়ি দোকানপাট রাস্তার মোড়ে বসিয়েছিলেন হাজারেরও বেশি ডাস্টবিন। এই ডাস্টবিনের নামে করতেন চাঁদাবাজি। পৌর এলাকার অধীননগর ‘স্যানিটারি ল্যান্ডফিল ও পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনাগার’ নামে কয়েক বিঘা জমির ওপর পৌরসভার ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য একটি নির্দিষ্ট জায়গা তৈরি করেছিলেন তারই আপন চাচা সাবেক মেয়র আব্দুল বাতেন। সেই আবর্জনার স্তূপে রঞ্জন গড়ে তুলেছিলেন শূকরের খামার। সেখানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ ছিল। শূকরের খামারে ছিল কয়েকশ শূকর। শূকরগুলো বিক্রি করতেন দেশ ও দেশের বাইরে। শূকরের খামার তৈরি করায় ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হলেও তার ভয়ে কেউই প্রকাশ্যে কোনো সমালোচনা করে সাহস পেত না। বেড়া-সাঁথিয়ায় টুকু রঞ্জনের বাড়িঘর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান লুটপাট ভাঙচুর হলেও এখনো রয়ে গেছে সেই শূকরের খামার।
জানা যায়, জাতীয় নির্বাচনে তার বিরুদ্ধে নির্বাচন করায় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, দোকান দখল ও বাড়ি ভাঙচুরসহ পুলিশ দিয়ে হয়রানির নানা অভিযোগ রয়েছে বাপবেটার বিরুদ্ধে। রঞ্জন বেড়া-সাঁথিয়ায় তালা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিলেন কয়েকশ দোকানপাট। সেই থেকে রঞ্জনের নাম দেন এলাকাবাসী তালাবাবা।
টুকু তার আপন ভাই বেড়া পৌর মেয়র আব্দুল বাতেনকে সরিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তার ছেলে আসিফ শামস রঞ্জনকে বানিয়েছেন বেড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বেড়া পৌরসভার মেয়র। তিনি তার নির্বাচনী এলাকা বেড়া ও সাঁথিয়ার মানুষের কাছে ছিলেন আতঙ্ক। তিনি যেভাবে খুশি এলাকায় সব কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। পৌর ও ইউপি নির্বাচন এলেই তার আশীর্বাদপুষ্ট নেতারাই নির্বাচিত হতেন মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে। যিনি বেশি টাকা দিতেন, তিনিই নির্বাচিত হতেন। তাদের বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়ালে তাকে যে কোনোভাবে তিনি পরাজিত করতে উঠেপড়ে লাগতেন। ক্ষমতার অপব্যবহারের আরেক নাম ছিল টুকু। পুলিশ তার কথার বাইরে গেলেই হতেন মুহূর্তে বদলি।
জানা গেছে, ২০০৮ সালে এমপি এবং প্রথমে জ্বালানি পরে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হয়ে শামসুল হক টুকুর বড় ছেলে আসিফ শামস ও ছোট ছেলে নাসিফ শামসকে দিয়ে এক প্রকার সামন্ততন্ত্র কায়েম করেন বেড়া সাঁথিয়ায়। ক্ষমতার অপব্যবহারে গড়ে তোলেন অবৈধ বালু উত্তোলন, জমি দখল, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ ও নিয়োগ বাণিজ্যের সিন্ডিকেট। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা প্রতিবাদ জানালে বিতর্কিত প্রক্রিয়ায় ছেলে আসিফকে বেড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও পৌরসভা মেয়র পদে বসান টুকু। অপ্রতিরোধ্য আসিফ সাঁথিয়ায় সরকারি মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র দখল করে গড়েন ব্যক্তিগত গো-খামার। বিআইডব্লিউটিএর বৃশালিখা ঘাট থেকে ইজারাদারকে তাড়িয়ে লুটে নেন কোটি কোটি টাকা। আসিফের মাস্তান বাহিনীর প্রকাশ্যে চাঁদাবাজিতে অসহায় ছিলেন স্থানীয়রা। বাবা-ছেলের ছত্রছায়ায় কাজের লোক থেকে হয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান, গাড়ির হেলপার থেকে হয়েছেন কোটিপতি। টুকু নিজ স্বার্থে তার আসনে গত দশ বছরে আওয়ামী লীগকে তিন ভাগে বিভক্ত করে রেখেছিলেন।
মেসার্স বেড়া ট্রান্সপোর্টের প্রোপাইটর নজরুল ইসলাম জানান, শামসুল টুকু আমার নামে ইজারাপ্রাপ্ত বৃশালিখা কোল ঘাট (নৌবন্দর) জোর করে দখল নিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরদিন ৬ আগস্ট আমি এই ঘাট ফেরত পাই। ক্ষমতায় থাকতে বৃশালিখা কোল ঘাটে আমার অফিস ভাঙচুর ও লুটপাট করেছিল টুকু ও তার ছেলে রঞ্জনের সন্ত্রাসী বাহিনী। বাড়ি ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ ছিল স্থানীয়দের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। বাপ-বেটার জবরদখলের প্রতিবাদ করে হামলা-মামলাসহ এলাকাছাড়া ছিল শত শত মানুষ। টুকু ও তার পরিবারের দুর্নীতি ও অত্যাচারের বিচার চাই আমরা।
বেড়া পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-১ এনামুল হক শামিম জানান, পায়না এলাকায় যমুনা নদীর তীরে টুকুর নিজ নামে প্রায় ৩০ বিঘা জমি ক্রয় করে ‘লুৎফুন্নেছা ইউনিভার্সিটি অব এগ্রিকালচার অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাবিত করেন। পরে ওই এলাকার আশপাশের ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গা নদীসহ প্রায় আরও ৫০ বিঘা জমি দখলে নেন। এখানে আমাদেরও ব্যক্তিগত কয়েক বিঘা জমি জোর করে দখল করে। প্রতিবাদ করায় মিথ্যা মামলা দিয়ে বাড়িছাড়া করেছে। আমি টুকুর দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই ও তার ছেলেকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই।
বেড়া পৌর এলাকার মান্নান মোল্লা জানান, টুকুর বিরুদ্ধে জাতীয় নির্বাচনে কাজ করায় টুকুর সন্ত্রাসী বাহিনী আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর এবং আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। এ ছাড়া টুকু হুড়াসাগর নদী থেকে কোটি কোটি টাকার বালু উত্তোলন ও নদীর জায়গা দখল করে বালু রেখেছে এবং আমাদের সেনাবাহিনী থেকে ক্রয় করা বালু জোর করে নিয়ে বিক্রি করেছে। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন টুকু ও তার ছেলে রঞ্জন। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান ভুক্তভোগীরা।