খুলনায় ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের পেছনে মাদক সিন্ডিকেট ও আধিপত্য বিস্তার
খুলনায় হঠাৎ বেড়েছে খুন, হামলা ও অস্ত্রবাজির ঘটনা। চলতি আগস্টের প্রথম ৮ দিনেই ৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে, আর কুপিয়ে ও গুলি করে আহত করা হয়েছে আরও ৩ জনকে। একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে নগরবাসী।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি) সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত নগরীতে সংঘটিত হয়েছে ৩১টি হত্যাকাণ্ড। এর আগের এক বছরে (২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট) এই সংখ্যা ছিল ১৯।
তদন্ত কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে মাদক সংক্রান্ত বিরোধ ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব। অন্তত ১১টি হত্যাকাণ্ডে মাদক সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর প্রভাব বিস্তারের বিরোধ পাওয়া গেছে। এছাড়া ইজিবাইক ও ভ্যান চুরি নিয়ে পাঁচ, প্রেমসংক্রান্ত বিরোধে পাঁচ, পারিবারিক কলহে তিন, নদীতে ভেসে আসা দুই, চুরি দেখে ফেলায় একজন, গণপিটুনিতে একজন এবং অন্যান্য কারণে আরও তিনজন নিহত হয়েছেন।
সাম্প্রতিক আলোচিত হত্যাকাণ্ড
১ আগস্ট রাতে নগরীর সবুজবাগ এলাকায় ঘরে ঢুকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় মনোয়ার হোসেন টগরকে। কয়েকদিন কেটে গেলেও মূল আসামিদের ধরতে পারেনি পুলিশ।
৩ আগস্ট মহেশ্বরপাশা উত্তর বনিকপাড়া এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ঘের ব্যবসায়ী আলামিন হাওলাদারকে। মৃত্যুর পরও সন্ত্রাসীরা তার গলা কেটে ফেলে। এ ঘটনায় নিহতের ভাই অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করলেও এখনও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
৫ আগস্ট রাত ৮টায় সঙ্গীতা সিনেমা হলের সামনে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করা হয় নিষিদ্ধ চরমপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) নেতা শাহাদাত হোসেনকে। প্রায় ২৩ বছর পর এ বছরের ৮ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্তি পান। তার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা ও অসংখ্য মামলা ছিল।
তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, গণঅভ্যুত্থানের পর সারাদেশের মতো খুলনাতেও পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়ে এবং তারা দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে। এ সুযোগে সন্ত্রাসী ও মাদককারবারীরা পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। অনেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে আবার পুরনো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় উঠতি সন্ত্রাসীরাও।
বিশ্লেষণে জানা যায়, নগরীর সশস্ত্র মহড়া, মাদক সংক্রান্ত বিরোধ ও হত্যাকাণ্ডে তিনটি বড় সশস্ত্র বাহিনী সক্রিয়। এর মধ্যে- রং মিস্ত্রি সোহেল, গোলাম হোসেন ও মনোয়ার হোসেন টগর হত্যাকাণ্ডে জড়িত গ্রেনেড বাবু বি-কম্পানি, পঙ্গু রাসেল হত্যায় পলাশ গ্রুপ, অর্ণব হত্যায় বি-কম্পানি ও পলাশ গ্রুপ যৌথভাবে, আমিন মোল্লা বোয়িং হত্যাকাণ্ডে আশিক গ্রুপ।
এছাড়া বড় শাহিন ও মাহাবুব হত্যায় জেলে থাকা চরমপন্থী নেতাদের অনুসারীদের নাম এসেছে। আলামিন হাওলাদার খুনেও একই গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
কেএমপি কমিশনার মোঃ জুলফিকার আলী হায়দার জানান, ২৭টি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন হয়েছে এবং এজাহারভুক্ত বেশিরভাগ আসামি কারাগারে রয়েছে। পলাশ বাহিনীর প্রধান শেখ পলাশ, সেকেন্ড ইন কমান্ড কালা লাভলু, নুর আজিম বাহিনীর প্রধান নুর আজিম, আশিক বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড সাগরসহ মোট ৫৪ জন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
একটির পর একটি হত্যাকাণ্ডে খুলনা নগরীর মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। সামাজিক মাধ্যমে অনেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার তীব্র সমালোচনা করছেন। খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব বাবুল হাওলাদার বলেন, “অভ্যুত্থানের এক বছরেও পুলিশ বাহিনী ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এ সুযোগে পলাতক সন্ত্রাসীরা এলাকায় ফিরে এসেছে এবং জেল থেকে বেরিয়েও অনেকে পুনরায় অপরাধে লিপ্ত হয়েছে। পুলিশ সক্রিয় না হলে এদের দমন কঠিন হবে।”
তিনি আরও বলেন, “নিরস্ত্র জনগণের আস্থা পুলিশের ওপর। এজন্য থানা পর্যায়ে চৌকস ও দক্ষ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া জরুরি। তাহলেই বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা ফিরে আসবে।”