ঢাকা ০৩:২৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সহিংসতার প্রতিবাদে ছাত্রলীগের ১২৪ নেতার পদত্যাগ

চেকপোস্ট ডেস্ক::

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ছাত্রলীগের অন্তত ১২৪ জন নেতাকর্মী পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। বিভিন্ন সময় সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন এসব নেতাকর্মী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাবি শাখা ছাত্রলীগ থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ১৮ নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছেন। তারা হলেন— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের সহসভাপতি জান্নাতুল মাওয়া, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি হাসিবুল হাসান হাসিব, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের অর্থ সম্পাদক জুয়েনা আলম মুন, আইন সম্পাদক সিরাজাম মনিরা তিশা, প্রচার সম্পাদক আমরিন জান্নাত তাইরু এবং নাট্য ও সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক মেহেরুন্নিসা মিম, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নুরুল ইসলাম হৃদয়, বিজ্ঞান উপ-সম্পাদক জেবা সায়ীমা, সার্জেন্ট জহরুল হক হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি ওয়াসিক, শামসুন নাহার হল ছাত্রলীগের উপ-পাঠাগার সম্পাদক ইসরাত জাহান সুমনা, বিজয় একাত্তর হল শাখার গ্রন্থনা ও প্রকাশনা উপ-সম্পাদক শাহ সাকিব সাদমান প্রান্ত, জসীমউদ্দিন হল ছাত্রলীগের মো. রাফিউল ইসলাম রাফি ও কার্যনির্বাহী সদস্য মেহেদী হাসান।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য পর রোববার রাতেই পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়া নেতারা হলেন- সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখার গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন সম্পাদক মাছুম শাহরিয়ার, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট শাখার মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণাবিষয়ক উপ-সম্পাদক রাতুল আহামেদ ওরফে শ্রাবণ, কলাভবন ছাত্রলীগের ১নং সহ সম্পাদক মো. মুহাইমিনুল ইসলাম, আইন অনুষদ শাখার গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক আশিকুর রহমান ওরফে জিম এবং রাসেল হোসেন।

রোকেয়া হলের সহসভাপতি জান্নাতুল মাওয়া বলেন, ‌‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রোকেয়া হল সহসভাপতি পদ থেকে মুক্তি নিলাম, পদত্যাগ ঘোষণা করেছি, যেহেতু রাজাকার বলে আখ্যায়িত করেছেন, রাজাকার হয়েই থাকতে চাই।’

বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি হাসিবুল হাসান হাসিব লেখেন, ‘আমি হাসিবুল হাসান হাসিব সহসভাপতি বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রলীগের সঙ্গে আমার পূর্বের সব সম্পর্ক ত্যাগ করলাম, আমার ছোট ভাই বন্ধুদের অনেককে নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে। ঘৃণা হচ্ছে ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে এতদিন কাজ করায়, বিদায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।’

বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের অর্থ সম্পাদক জুয়েনা আলম মুন লেখেন, ‘ন্যায়ের কাণ্ডারি ভেবে ছাত্রলীগ করতাম। কিন্তু এখন এই সংগঠনের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা ছিল এটাও মনে করলে আমার রক্তাক্ত বন্ধুবান্ধবী, সিনিয়র, জুনিয়রদের চেহারা মনে পড়বে। তাই স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে পদত্যাগ করছি।’

ইসরাত জাহান সুমনা লেখেন, ‘আমি ইসরাত জাহান সুমনা উপ-পাঠাগার সম্পাদক বাংলাদেশ শামসুন নাহার হল শাখা ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পদ থেকে সজ্ঞানে অব্যাহতি নিচ্ছি। এই পদ এবং সংগঠনে আমার কোনো পরিচয় নেই, বরং ঘৃণিত ও লজ্জিত হবো নিজের কাছে।’

নুরুল ইসলাম হৃদয় ফেসবুক লেখেন, ‘আমি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখা ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বজ্ঞানে অব্যাহতি নিচ্ছি। যেই সংগঠন আমার বোনের মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে; বোনের গায়ে হাত দেয়, আমার ভাইকে রডের বাড়ি মেরে মেরে আধমরা করে ফেলে দেয় রাস্তায়, তারাই নাকি আমার ভাই-বন্ধু! আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করার অঙ্গীকার করেছিলাম। এটা কখনো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হতে পারে না। আমি লজ্জিত।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

একই ইস্যুতে জাহাঙ্গীরনগর শাখা ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেছেন অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বিভিন্ন ইউনিট থেকে পদত্যাগ করে সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তারাও।

পদত্যাগকারীদের মধ্যে রয়েছেন, শেখ রাসেল হল শাখা ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদ সামি, শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ইমরান আহমেদ, শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক আফরিন আলম রিমি, নিয়ামুল আরফে, খাদিজা জুই, সিদরাতুল মুনতাহা, রিপনুল ইসলাম রবিন প্রমুখসহ অর্ধ শতাধিক নেতাকর্মীরা।

ইমরান আহমেদ তার ফেসবুক পোস্টে লিখেন, ‘একটা আদর্শ বুকে নিয়ে কোনো প্রকার স্বার্থের বাইরে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতাম। কিন্তু গতকাল রাতের ঘটনার পরেও যদি চুপ থাকি তাহলে নিজের বিবেক আর আদর্শের কাছে সারাজীবন অপরাধী হয়ে থেকে যাব। আমি ইমরান বশর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী সদস্য। আজকের পর থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সমস্ত রকম কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে অব্যাহতি দিলাম।’

আফরিন আলম রিমি ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে লিখেন, ‘বিবেকের কাছে পদ পদবি; ক্ষমতার জন্য হেরে যেতে পারবো না। আমি আফরিন আলম রিমি, আজ থেকে সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে নিষ্কৃতি দিলাম।’

শেখ রাসেল হল শাখা ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক মোহাম্মদ সামি তার পোস্টে লেখেন, ‘আমি মো. সামি, দফতর সম্পাদক শেখ রাসেল হল ছাত্রলীগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এই মুহূর্ত থেকে সাংগঠনিক সকল দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিলাম। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তৈরি হয়েছিল, কিছু লক্ষ্য উদ্দেশ্য সামনে রেখে। এক কথায় সংগঠনটি হবে শিক্ষার্থীদেরকে সাথে নিয়ে শিক্ষার্থীবান্ধব একটি ছাত্রসংগঠন। তারা দেশের যেকোনো অন্যায়, অবিচার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলবে, অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থাকবে, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিদাওয়া আদায়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ থেকে যোজন যোজন দূরে সরে গেছি! তাই এখন যা হচ্ছে আমার ক্যাম্পাসে সেইটা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ মানতে পারে না। জীবনে কোনো দিন জুলুম করিনি, কারো সাথে অন্যায় করিনি। ইনশাআল্লাহ, বেঁচে থাকলে কখনো বিবেক বিসর্জন দিবো না। আমি সৃষ্টি তাই স্রষ্টায় বিশ্বাস করি এবং আমার বিশ্বাস প্রতিটি রাবার বুলেট, টিআর শেল ও অন্যায়ের হিসাব দিতে হবে।’

শাখা ছাত্রলীগের উপ-ধর্ম সম্পাদক নাঈমুল আরাফী তার পোস্টে লিখেন, ‘একটা আদর্শ বুকে নিয়ে কোনো স্বার্থের বাইরে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতাম। কিন্তু গতকাল রাতের ঘটনার পরেও যদি চুপ থাকি তাহলে নিজের বিবেক আর আদর্শের কাছে সারাজীবন অপরাধী হয়ে থেকে যাব। আমি শেখ মো. নাঈমুল আরাফী, উপ-ধর্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। আজকের পর থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সমস্ত রকম কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে অব্যাহতি দিলাম।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

একই ইস্যুতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগ থেকেই ইস্তফা দিয়েছেন বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। এখন পর্যন্ত এমন ৬ জনের নাম পাওয়া গেছে। সামাজিকমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করা এসব নেতা হলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ শাখার সহ-সভাপতি মাহমুদুল হাসান সামি ও রসায়ন বিভাগ শাখার সহসভাপতি তাওসিফ কবির, মনোবিজ্ঞান বিভাগ শাখার সহসভাপতি রনি সরকার ও যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. আশিকুর রহমান এবং ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ শাখার সহসভাপতি মাহমুদুল হাসান নোমান এবং শিঞ্জন বসাক।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

কুবি শাখা ছাত্রলীগ থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থী পদত্যাগ করে সামাজিকমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। পদত্যাগকারী নেতাকর্মীরা জানান, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়েও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ অতর্কিত হামলা চালায়। এই ঘটনায় তারা নিন্দা জানিয়ে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেন।

পোস্টে এক পদত্যাগকারী লেখেন, ‘অতীতে ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম এটা জেনে যে, ছাত্রলীগ ছাত্রদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করে। তবে বর্তমান ছাত্রলীগ যা বোঝাল, এতে এই মুহূর্ত থেকে আমি আর কোনোভাবেই ছাত্রলীগের কোনো কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে প্রথম পদত্যাগকারী নুসরাত জাহান সুরভী বলেন, ‘আপনিও মানুষ, আমিও মানুষ। আপনিও জানেন দেশে কি হচ্ছে। সেই মানবিক দিক বিবেচনা করে আমি শাখা ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেছি।’

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. বোরহান উদ্দিন তার ফেসবুকে লেখেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন থেকে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। ছাত্র রাজনীতি ছিল আমার পছন্দের জায়গা, ভালোবাসার জায়গা। আজকের পর থেকে ছাত্রলীগের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কেউ আমাকে ডাকবেন না, ধন্যবাদ।’

আরেক পদত্যাগকারী লেখেন, ‘আমি রাহিলাতুল শবনম মিম। আমিসহ নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী হলের ১৬তম ব্যাচের সব পলিটিক্যাল মেয়ে ছাত্রলীগ থেকে ইস্তফা দিলাম। আজ থেকে লীগের কোনো প্রোগ্রামে আমরা যাব না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সামিন বখশ সাদী বলেন, ‘প্রথমবর্ষ থেকে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। ছাত্র রাজনীতি ছিল আমার পছন্দের জায়গা। কিন্তু, আজকের এই ঘটনার পর আমার মনে হয় না এরকম কেনোকিছুর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখা প্রয়োজন।’

উল্লেখ্য, চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কিছুই পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা সব পাবে?’। প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা বা নাতিপুতি’ বলা হয়েছে অভিযোগ করে রোববার রাত থেকে প্রতিবাদ শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এরপর আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীজুড়ে। এবার সেই আন্দোলন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

ট্যাগস :

নিউজটি টাইম লাইনে শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

চেকপোস্ট

Checkpost is one of the most popular Bengali news portal and print newspaper in Bangladesh. The print and online news portal started its operations with a commitment to fearless, investigative, informative and unbiased journalism.
আপডেট সময় ০৭:৫৯:৫২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই ২০২৪
৫৩৭ বার পড়া হয়েছে

সহিংসতার প্রতিবাদে ছাত্রলীগের ১২৪ নেতার পদত্যাগ

আপডেট সময় ০৭:৫৯:৫২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই ২০২৪

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ছাত্রলীগের অন্তত ১২৪ জন নেতাকর্মী পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। বিভিন্ন সময় সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন এসব নেতাকর্মী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাবি শাখা ছাত্রলীগ থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ১৮ নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছেন। তারা হলেন— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের সহসভাপতি জান্নাতুল মাওয়া, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি হাসিবুল হাসান হাসিব, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের অর্থ সম্পাদক জুয়েনা আলম মুন, আইন সম্পাদক সিরাজাম মনিরা তিশা, প্রচার সম্পাদক আমরিন জান্নাত তাইরু এবং নাট্য ও সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক মেহেরুন্নিসা মিম, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নুরুল ইসলাম হৃদয়, বিজ্ঞান উপ-সম্পাদক জেবা সায়ীমা, সার্জেন্ট জহরুল হক হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি ওয়াসিক, শামসুন নাহার হল ছাত্রলীগের উপ-পাঠাগার সম্পাদক ইসরাত জাহান সুমনা, বিজয় একাত্তর হল শাখার গ্রন্থনা ও প্রকাশনা উপ-সম্পাদক শাহ সাকিব সাদমান প্রান্ত, জসীমউদ্দিন হল ছাত্রলীগের মো. রাফিউল ইসলাম রাফি ও কার্যনির্বাহী সদস্য মেহেদী হাসান।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য পর রোববার রাতেই পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়া নেতারা হলেন- সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখার গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন সম্পাদক মাছুম শাহরিয়ার, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট শাখার মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণাবিষয়ক উপ-সম্পাদক রাতুল আহামেদ ওরফে শ্রাবণ, কলাভবন ছাত্রলীগের ১নং সহ সম্পাদক মো. মুহাইমিনুল ইসলাম, আইন অনুষদ শাখার গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক আশিকুর রহমান ওরফে জিম এবং রাসেল হোসেন।

রোকেয়া হলের সহসভাপতি জান্নাতুল মাওয়া বলেন, ‌‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রোকেয়া হল সহসভাপতি পদ থেকে মুক্তি নিলাম, পদত্যাগ ঘোষণা করেছি, যেহেতু রাজাকার বলে আখ্যায়িত করেছেন, রাজাকার হয়েই থাকতে চাই।’

বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি হাসিবুল হাসান হাসিব লেখেন, ‘আমি হাসিবুল হাসান হাসিব সহসভাপতি বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রলীগের সঙ্গে আমার পূর্বের সব সম্পর্ক ত্যাগ করলাম, আমার ছোট ভাই বন্ধুদের অনেককে নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে। ঘৃণা হচ্ছে ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে এতদিন কাজ করায়, বিদায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।’

বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের অর্থ সম্পাদক জুয়েনা আলম মুন লেখেন, ‘ন্যায়ের কাণ্ডারি ভেবে ছাত্রলীগ করতাম। কিন্তু এখন এই সংগঠনের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা ছিল এটাও মনে করলে আমার রক্তাক্ত বন্ধুবান্ধবী, সিনিয়র, জুনিয়রদের চেহারা মনে পড়বে। তাই স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে পদত্যাগ করছি।’

ইসরাত জাহান সুমনা লেখেন, ‘আমি ইসরাত জাহান সুমনা উপ-পাঠাগার সম্পাদক বাংলাদেশ শামসুন নাহার হল শাখা ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পদ থেকে সজ্ঞানে অব্যাহতি নিচ্ছি। এই পদ এবং সংগঠনে আমার কোনো পরিচয় নেই, বরং ঘৃণিত ও লজ্জিত হবো নিজের কাছে।’

নুরুল ইসলাম হৃদয় ফেসবুক লেখেন, ‘আমি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখা ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বজ্ঞানে অব্যাহতি নিচ্ছি। যেই সংগঠন আমার বোনের মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে; বোনের গায়ে হাত দেয়, আমার ভাইকে রডের বাড়ি মেরে মেরে আধমরা করে ফেলে দেয় রাস্তায়, তারাই নাকি আমার ভাই-বন্ধু! আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করার অঙ্গীকার করেছিলাম। এটা কখনো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হতে পারে না। আমি লজ্জিত।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

একই ইস্যুতে জাহাঙ্গীরনগর শাখা ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেছেন অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বিভিন্ন ইউনিট থেকে পদত্যাগ করে সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তারাও।

পদত্যাগকারীদের মধ্যে রয়েছেন, শেখ রাসেল হল শাখা ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদ সামি, শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ইমরান আহমেদ, শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক আফরিন আলম রিমি, নিয়ামুল আরফে, খাদিজা জুই, সিদরাতুল মুনতাহা, রিপনুল ইসলাম রবিন প্রমুখসহ অর্ধ শতাধিক নেতাকর্মীরা।

ইমরান আহমেদ তার ফেসবুক পোস্টে লিখেন, ‘একটা আদর্শ বুকে নিয়ে কোনো প্রকার স্বার্থের বাইরে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতাম। কিন্তু গতকাল রাতের ঘটনার পরেও যদি চুপ থাকি তাহলে নিজের বিবেক আর আদর্শের কাছে সারাজীবন অপরাধী হয়ে থেকে যাব। আমি ইমরান বশর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী সদস্য। আজকের পর থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সমস্ত রকম কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে অব্যাহতি দিলাম।’

আফরিন আলম রিমি ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে লিখেন, ‘বিবেকের কাছে পদ পদবি; ক্ষমতার জন্য হেরে যেতে পারবো না। আমি আফরিন আলম রিমি, আজ থেকে সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে নিষ্কৃতি দিলাম।’

শেখ রাসেল হল শাখা ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক মোহাম্মদ সামি তার পোস্টে লেখেন, ‘আমি মো. সামি, দফতর সম্পাদক শেখ রাসেল হল ছাত্রলীগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এই মুহূর্ত থেকে সাংগঠনিক সকল দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিলাম। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তৈরি হয়েছিল, কিছু লক্ষ্য উদ্দেশ্য সামনে রেখে। এক কথায় সংগঠনটি হবে শিক্ষার্থীদেরকে সাথে নিয়ে শিক্ষার্থীবান্ধব একটি ছাত্রসংগঠন। তারা দেশের যেকোনো অন্যায়, অবিচার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলবে, অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থাকবে, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিদাওয়া আদায়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ থেকে যোজন যোজন দূরে সরে গেছি! তাই এখন যা হচ্ছে আমার ক্যাম্পাসে সেইটা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ মানতে পারে না। জীবনে কোনো দিন জুলুম করিনি, কারো সাথে অন্যায় করিনি। ইনশাআল্লাহ, বেঁচে থাকলে কখনো বিবেক বিসর্জন দিবো না। আমি সৃষ্টি তাই স্রষ্টায় বিশ্বাস করি এবং আমার বিশ্বাস প্রতিটি রাবার বুলেট, টিআর শেল ও অন্যায়ের হিসাব দিতে হবে।’

শাখা ছাত্রলীগের উপ-ধর্ম সম্পাদক নাঈমুল আরাফী তার পোস্টে লিখেন, ‘একটা আদর্শ বুকে নিয়ে কোনো স্বার্থের বাইরে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতাম। কিন্তু গতকাল রাতের ঘটনার পরেও যদি চুপ থাকি তাহলে নিজের বিবেক আর আদর্শের কাছে সারাজীবন অপরাধী হয়ে থেকে যাব। আমি শেখ মো. নাঈমুল আরাফী, উপ-ধর্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। আজকের পর থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সমস্ত রকম কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে অব্যাহতি দিলাম।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

একই ইস্যুতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগ থেকেই ইস্তফা দিয়েছেন বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। এখন পর্যন্ত এমন ৬ জনের নাম পাওয়া গেছে। সামাজিকমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করা এসব নেতা হলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ শাখার সহ-সভাপতি মাহমুদুল হাসান সামি ও রসায়ন বিভাগ শাখার সহসভাপতি তাওসিফ কবির, মনোবিজ্ঞান বিভাগ শাখার সহসভাপতি রনি সরকার ও যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. আশিকুর রহমান এবং ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ শাখার সহসভাপতি মাহমুদুল হাসান নোমান এবং শিঞ্জন বসাক।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

কুবি শাখা ছাত্রলীগ থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থী পদত্যাগ করে সামাজিকমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। পদত্যাগকারী নেতাকর্মীরা জানান, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়েও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ অতর্কিত হামলা চালায়। এই ঘটনায় তারা নিন্দা জানিয়ে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেন।

পোস্টে এক পদত্যাগকারী লেখেন, ‘অতীতে ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম এটা জেনে যে, ছাত্রলীগ ছাত্রদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করে। তবে বর্তমান ছাত্রলীগ যা বোঝাল, এতে এই মুহূর্ত থেকে আমি আর কোনোভাবেই ছাত্রলীগের কোনো কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে প্রথম পদত্যাগকারী নুসরাত জাহান সুরভী বলেন, ‘আপনিও মানুষ, আমিও মানুষ। আপনিও জানেন দেশে কি হচ্ছে। সেই মানবিক দিক বিবেচনা করে আমি শাখা ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেছি।’

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. বোরহান উদ্দিন তার ফেসবুকে লেখেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন থেকে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। ছাত্র রাজনীতি ছিল আমার পছন্দের জায়গা, ভালোবাসার জায়গা। আজকের পর থেকে ছাত্রলীগের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কেউ আমাকে ডাকবেন না, ধন্যবাদ।’

আরেক পদত্যাগকারী লেখেন, ‘আমি রাহিলাতুল শবনম মিম। আমিসহ নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী হলের ১৬তম ব্যাচের সব পলিটিক্যাল মেয়ে ছাত্রলীগ থেকে ইস্তফা দিলাম। আজ থেকে লীগের কোনো প্রোগ্রামে আমরা যাব না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সামিন বখশ সাদী বলেন, ‘প্রথমবর্ষ থেকে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। ছাত্র রাজনীতি ছিল আমার পছন্দের জায়গা। কিন্তু, আজকের এই ঘটনার পর আমার মনে হয় না এরকম কেনোকিছুর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখা প্রয়োজন।’

উল্লেখ্য, চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কিছুই পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা সব পাবে?’। প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা বা নাতিপুতি’ বলা হয়েছে অভিযোগ করে রোববার রাত থেকে প্রতিবাদ শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এরপর আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীজুড়ে। এবার সেই আন্দোলন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।