ঢাকা ১১:১৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৮ মে ২০২৫, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পান্তা ভাত এলিটদের একদিনের সংস্কৃতি, দরিদ্রের নিত্যদিনের আহার

শহীদুল ইসলাম শরীফ, স্টাফ রিপোর্টার::

গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খাবার পান্তা ভাত আজকাল হয়ে উঠেছে একদিনের উৎসবের খাবার। নববর্ষে ইলিশ মাছের সাথে পান্তা পরিবেশন এখন একটি সংস্কৃতি, কিন্তু এই সংস্কৃতি সারাবছর যাদের জীবনের বাস্তবতা, তারা হলো দেশের খেটে খাওয়া মানুষ।

একসময় প্রতিটি গ্রামবাংলার ঘরে সকালে পান্তা ভাত খাওয়ার দৃশ্য ছিল স্বাভাবিক। রাতের বেঁচে যাওয়া ভাত পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে লবণ, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ কিংবা ভর্তার সঙ্গে খাওয়া হতো। এই সাধারণ খাবারেই ছিল গ্রামীণ জীবনের সরলতা ও খাদ্য নিরাপত্তা।

আজকের দিনে শহুরে উচ্চবিত্তরা বছরের একদিন পান্তা খেয়ে বাঙালিয়ানার পরিচয় দেয়, অন্যদিকে দরিদ্র শ্রেণির মানুষদের কাছে এটা প্রয়োজনের বাস্তবতা। শহরের কেউ কেউ এটিকে “লোকজ ঐতিহ্য” বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন, কিন্তু বছরের বাকি দিনগুলোতে পান্তা ভাতকে তারা তুচ্ছ করে দেখেন।

পুষ্টিগুণে উপেক্ষিত নয় পান্তা ভাত

পান্তা ভাত পুষ্টিগুণহীন নয়, বরং এতে কিছু দরকারি উপাদান রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম পান্তা ভাতে পাওয়া যায়:

  • কার্বোহাইড্রেট: ২৫-৩০ গ্রাম

  • প্রোটিন: ২-৩ গ্রাম

  • ফাইবার: ০.৫-১ গ্রাম

  • ভিটামিন বি গ্রুপ ও খনিজ উপাদান: সামান্য পরিমাণে

  • প্রোবায়োটিক উপাদান: অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখে, হজমে সহায়তা করে

  • তাপজনিত সমস্যা থেকে সুরক্ষা: শরীরকে ঠান্ডা রাখে

গ্রীষ্মপ্রধান দেশে শরীর ঠান্ডা রাখতে এবং গ্যাস্ট্রিকজনিত সমস্যায় পান্তা উপকারী হতে পারে। এটি সহজলভ্য, সাশ্রয়ী এবং স্বল্পআয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান রাখে।

ক্ষতিকর দিকও রয়েছে

তবে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে পান্তা ভাত বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। দীর্ঘক্ষণ রেখে দিলে এতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া জন্ম নিতে পারে, যার ফলে খাদ্যে বিষক্রিয়ার আশঙ্কা বাড়ে। এছাড়া অতিরিক্ত লবণ ব্যবহারে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে।

ভিটামিন বি১২-এর অভাব, প্রোটিন ঘাটতি এবং দীর্ঘক্ষণ ফারমেন্টেশনে অ্যালকোহলের উপস্থিতিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করতে পারে।

সংস্কৃতি, শ্রেণি ও সচেতনতা

একদিকে পান্তা ভাত হয়ে উঠেছে উচ্চবিত্তের উৎসব, অন্যদিকে দরিদ্রের জীবনসংগ্রামের নিত্যসঙ্গী। আজকের তরুণ সমাজ জাঙ্ক ফুডকে স্ট্যাটাসের প্রতীক মনে করে, অথচ নিজেদের ঐতিহ্যবাহী ও স্বাস্থ্যকর খাবার পান্তাকে তুচ্ছ করে দেখে।

খাদ্য কেবল পেটের আহার নয়, এটি একটি জাতির সংস্কৃতির পরিচয়। পান্তা ভাত আমাদের কৃষিভিত্তিক জীবনের এক অনবদ্য অংশ, যা শুধু খাদ্য নয়, আমাদের অতীত, আবেগ ও পরিচয়ের ধারক।

শেষ কথা

পান্তা ভাতকে শুধু নববর্ষের আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ না রেখে এর পুষ্টিগুণ, সহজলভ্যতা ও ঐতিহ্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া দরকার। সচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে পান্তা ভাত যেমন হতে পারে একটি নিরাপদ খাবার, তেমনি এটি হতে পারে আত্মপরিচয়ের গর্বিত প্রতীক।

ট্যাগস :

নিউজটি টাইম লাইনে শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

চেকপোস্ট

Checkpost is one of the most popular Bengali news portal and print newspaper in Bangladesh. The print and online news portal started its operations with a commitment to fearless, investigative, informative and unbiased journalism.
আপডেট সময় ০৪:৩৪:১৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ মে ২০২৫
৫২২ বার পড়া হয়েছে

পান্তা ভাত এলিটদের একদিনের সংস্কৃতি, দরিদ্রের নিত্যদিনের আহার

আপডেট সময় ০৪:৩৪:১৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ মে ২০২৫

গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খাবার পান্তা ভাত আজকাল হয়ে উঠেছে একদিনের উৎসবের খাবার। নববর্ষে ইলিশ মাছের সাথে পান্তা পরিবেশন এখন একটি সংস্কৃতি, কিন্তু এই সংস্কৃতি সারাবছর যাদের জীবনের বাস্তবতা, তারা হলো দেশের খেটে খাওয়া মানুষ।

একসময় প্রতিটি গ্রামবাংলার ঘরে সকালে পান্তা ভাত খাওয়ার দৃশ্য ছিল স্বাভাবিক। রাতের বেঁচে যাওয়া ভাত পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে লবণ, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ কিংবা ভর্তার সঙ্গে খাওয়া হতো। এই সাধারণ খাবারেই ছিল গ্রামীণ জীবনের সরলতা ও খাদ্য নিরাপত্তা।

আজকের দিনে শহুরে উচ্চবিত্তরা বছরের একদিন পান্তা খেয়ে বাঙালিয়ানার পরিচয় দেয়, অন্যদিকে দরিদ্র শ্রেণির মানুষদের কাছে এটা প্রয়োজনের বাস্তবতা। শহরের কেউ কেউ এটিকে “লোকজ ঐতিহ্য” বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন, কিন্তু বছরের বাকি দিনগুলোতে পান্তা ভাতকে তারা তুচ্ছ করে দেখেন।

পুষ্টিগুণে উপেক্ষিত নয় পান্তা ভাত

পান্তা ভাত পুষ্টিগুণহীন নয়, বরং এতে কিছু দরকারি উপাদান রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম পান্তা ভাতে পাওয়া যায়:

  • কার্বোহাইড্রেট: ২৫-৩০ গ্রাম

  • প্রোটিন: ২-৩ গ্রাম

  • ফাইবার: ০.৫-১ গ্রাম

  • ভিটামিন বি গ্রুপ ও খনিজ উপাদান: সামান্য পরিমাণে

  • প্রোবায়োটিক উপাদান: অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখে, হজমে সহায়তা করে

  • তাপজনিত সমস্যা থেকে সুরক্ষা: শরীরকে ঠান্ডা রাখে

গ্রীষ্মপ্রধান দেশে শরীর ঠান্ডা রাখতে এবং গ্যাস্ট্রিকজনিত সমস্যায় পান্তা উপকারী হতে পারে। এটি সহজলভ্য, সাশ্রয়ী এবং স্বল্পআয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান রাখে।

ক্ষতিকর দিকও রয়েছে

তবে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে পান্তা ভাত বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। দীর্ঘক্ষণ রেখে দিলে এতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া জন্ম নিতে পারে, যার ফলে খাদ্যে বিষক্রিয়ার আশঙ্কা বাড়ে। এছাড়া অতিরিক্ত লবণ ব্যবহারে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে।

ভিটামিন বি১২-এর অভাব, প্রোটিন ঘাটতি এবং দীর্ঘক্ষণ ফারমেন্টেশনে অ্যালকোহলের উপস্থিতিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করতে পারে।

সংস্কৃতি, শ্রেণি ও সচেতনতা

একদিকে পান্তা ভাত হয়ে উঠেছে উচ্চবিত্তের উৎসব, অন্যদিকে দরিদ্রের জীবনসংগ্রামের নিত্যসঙ্গী। আজকের তরুণ সমাজ জাঙ্ক ফুডকে স্ট্যাটাসের প্রতীক মনে করে, অথচ নিজেদের ঐতিহ্যবাহী ও স্বাস্থ্যকর খাবার পান্তাকে তুচ্ছ করে দেখে।

খাদ্য কেবল পেটের আহার নয়, এটি একটি জাতির সংস্কৃতির পরিচয়। পান্তা ভাত আমাদের কৃষিভিত্তিক জীবনের এক অনবদ্য অংশ, যা শুধু খাদ্য নয়, আমাদের অতীত, আবেগ ও পরিচয়ের ধারক।

শেষ কথা

পান্তা ভাতকে শুধু নববর্ষের আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ না রেখে এর পুষ্টিগুণ, সহজলভ্যতা ও ঐতিহ্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া দরকার। সচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে পান্তা ভাত যেমন হতে পারে একটি নিরাপদ খাবার, তেমনি এটি হতে পারে আত্মপরিচয়ের গর্বিত প্রতীক।