ঢাকা ০১:২৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ মার্চ ২০২৫, ২৬ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ছেলের কাছে ‘মা’ এর লেখা চিঠি

শহীদুল ইসলাম শরীফ, স্টাফ রিপোর্টার::

ছবি: নেট থেকে নেয়া

বৃদ্ধাশ্রম—এ যেন জীবনের শেষ প্রান্তে একটি নিঃসঙ্গ আশ্রয়স্থল। আমাদের সমাজে এটি মূলত বার্ধক্যজনিত অসহায়ত্বের প্রতীক। যে মা-বাবা এক সময় সন্তানদের জন্য নিজেদের সর্বস্ব উৎসর্গ করেছেন, তিলে তিলে তাদের গড়ে তুলেছেন, সেই মা-বাবার শেষ জীবনের ঠিকানা হয়ে যায় বৃদ্ধাশ্রম। এটি শুধু মানবতার প্রতি উপহাস নয়, বরং আমাদের সমাজব্যবস্থার এক নির্মম চিত্র।

যে মা সন্তান না খেলে খেতেন না, সন্তান অসুস্থ হলে যিনি সারারাত জেগে থাকতেন, সেই মায়ের শেষ জীবনে কীভাবে এমন পরিণতি হয়? সন্তানের অবহেলা, বঞ্চনা ও দায়িত্বহীনতার জন্য একসময় প্রতিষ্ঠিত মানুষকেও বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিতে হয়। অনেক সন্তানই তাদের মা-বাবাকে ছেড়ে দূর দেশে চলে যায়, খোঁজখবর নেয় না। কন্যা তার মায়ের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়। এক পিতার কথা বলা যায়, যিনি নিজের অসুস্থ শরীরে ছেলের হাতখরচের জন্য টাকা চেয়েছিলেন, অথচ সেই সন্তান তাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। অথচ এই বাবাই ছেলের বেকার অবস্থায় মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছিলেন।

অন্য একটি ঘটনায় দেখা যায়, এক ছেলে তর্কের একপর্যায়ে বঁটি হাতে তার বাবাকে আঘাত করার জন্য উদ্ধত হয়েছিল। অথচ এই বাবাই তাকে মানুষ করতে নিজের সর্বস্ব নিঃশেষ করেছেন। বৃদ্ধাশ্রম থেকে এক মা তার ছেলেকে চিঠি লিখে বলেন, ছয় মাস আগে তিনি একটি চশমা চেয়েছিলেন, কিন্তু তা এখনো পাননি।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মায়ের ডাকের কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—তিনি মায়ের চিঠি পেয়ে ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে, চাকরি ছেড়ে নদী সাঁতরে মায়ের কাছে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু আজকের দিনে সন্তানেরা মা-বাবার অসহায়ত্ব শুনে যেন উল্টো দিকেই ছুটে যায়।

বিদেশে বৃদ্ধাশ্রম একটি নিয়মিত বিষয়। তারা বছরে একবার বৃদ্ধ মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মা-বাবারা অনেক সময় সেই নির্ধারিত দিনেও সন্তানদের দেখতে পান না। তারা ফেসবুকে সরব থাকলেও বাস্তবে মা-বাবার খোঁজ নেওয়ার সময় হয় না।

ইসলাম ধর্মে মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন,

“আমি মানুষকে তার পিতা-মাতা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট সয়ে গর্ভে ধারণ করেছে এবং তাকে দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। তোমরা শোকর করো আমার এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি। আমার কাছেই তোমাদের ফিরে আসতে হবে।”
(সুরা লোকমান, আয়াত ১৪)

আবার বলা হয়েছে,

“তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। পিতা-মাতার কেউ যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের ‘উফ’ পর্যন্ত বলো না এবং তাদের ধমক দিও না। বরং তাদের প্রতি সম্মানের সঙ্গে কথা বলো।”
(সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত ২৩-২৪)

ইতিহাস বলে, পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ শতকে, চীনের শান রাজবংশে। তখন সেখানে বৃদ্ধদের জন্য আরাম-আয়েশ, খাদ্য ও বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এখন বৃদ্ধাশ্রমের চিত্র বদলে গেছে। বর্তমান সমাজে অনেক মা-বাবা দিন কাটান সন্তানদের জন্য অপেক্ষায়, তাদের চোখের পানিতে। তাদের ডাক আর সন্তানের কাছে পৌঁছায় না।

সমাজের এই অমানবিক চিত্র পাল্টাতে হবে। আমাদের সন্তানদের দায়িত্বশীল হতে হবে এবং মা-বাবার প্রতি তাদের কর্তব্য পালন করতে হবে। একজন মায়ের লেখা এই চিঠি যেন আমাদের বিবেককে জাগিয়ে তোলে।

ট্যাগস :

নিউজটি টাইম লাইনে শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

চেকপোস্ট

Checkpost is one of the most popular Bengali news portal and print newspaper in Bangladesh. The print and online news portal started its operations with a commitment to fearless, investigative, informative and unbiased journalism.
আপডেট সময় ১১:৪২:০০ অপরাহ্ন, রবিবার, ৫ জানুয়ারী ২০২৫
৫৮০ বার পড়া হয়েছে

ছেলের কাছে ‘মা’ এর লেখা চিঠি

আপডেট সময় ১১:৪২:০০ অপরাহ্ন, রবিবার, ৫ জানুয়ারী ২০২৫

বৃদ্ধাশ্রম—এ যেন জীবনের শেষ প্রান্তে একটি নিঃসঙ্গ আশ্রয়স্থল। আমাদের সমাজে এটি মূলত বার্ধক্যজনিত অসহায়ত্বের প্রতীক। যে মা-বাবা এক সময় সন্তানদের জন্য নিজেদের সর্বস্ব উৎসর্গ করেছেন, তিলে তিলে তাদের গড়ে তুলেছেন, সেই মা-বাবার শেষ জীবনের ঠিকানা হয়ে যায় বৃদ্ধাশ্রম। এটি শুধু মানবতার প্রতি উপহাস নয়, বরং আমাদের সমাজব্যবস্থার এক নির্মম চিত্র।

যে মা সন্তান না খেলে খেতেন না, সন্তান অসুস্থ হলে যিনি সারারাত জেগে থাকতেন, সেই মায়ের শেষ জীবনে কীভাবে এমন পরিণতি হয়? সন্তানের অবহেলা, বঞ্চনা ও দায়িত্বহীনতার জন্য একসময় প্রতিষ্ঠিত মানুষকেও বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিতে হয়। অনেক সন্তানই তাদের মা-বাবাকে ছেড়ে দূর দেশে চলে যায়, খোঁজখবর নেয় না। কন্যা তার মায়ের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়। এক পিতার কথা বলা যায়, যিনি নিজের অসুস্থ শরীরে ছেলের হাতখরচের জন্য টাকা চেয়েছিলেন, অথচ সেই সন্তান তাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। অথচ এই বাবাই ছেলের বেকার অবস্থায় মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছিলেন।

অন্য একটি ঘটনায় দেখা যায়, এক ছেলে তর্কের একপর্যায়ে বঁটি হাতে তার বাবাকে আঘাত করার জন্য উদ্ধত হয়েছিল। অথচ এই বাবাই তাকে মানুষ করতে নিজের সর্বস্ব নিঃশেষ করেছেন। বৃদ্ধাশ্রম থেকে এক মা তার ছেলেকে চিঠি লিখে বলেন, ছয় মাস আগে তিনি একটি চশমা চেয়েছিলেন, কিন্তু তা এখনো পাননি।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মায়ের ডাকের কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—তিনি মায়ের চিঠি পেয়ে ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে, চাকরি ছেড়ে নদী সাঁতরে মায়ের কাছে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু আজকের দিনে সন্তানেরা মা-বাবার অসহায়ত্ব শুনে যেন উল্টো দিকেই ছুটে যায়।

বিদেশে বৃদ্ধাশ্রম একটি নিয়মিত বিষয়। তারা বছরে একবার বৃদ্ধ মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মা-বাবারা অনেক সময় সেই নির্ধারিত দিনেও সন্তানদের দেখতে পান না। তারা ফেসবুকে সরব থাকলেও বাস্তবে মা-বাবার খোঁজ নেওয়ার সময় হয় না।

ইসলাম ধর্মে মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন,

“আমি মানুষকে তার পিতা-মাতা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট সয়ে গর্ভে ধারণ করেছে এবং তাকে দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। তোমরা শোকর করো আমার এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি। আমার কাছেই তোমাদের ফিরে আসতে হবে।”
(সুরা লোকমান, আয়াত ১৪)

আবার বলা হয়েছে,

“তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। পিতা-মাতার কেউ যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের ‘উফ’ পর্যন্ত বলো না এবং তাদের ধমক দিও না। বরং তাদের প্রতি সম্মানের সঙ্গে কথা বলো।”
(সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত ২৩-২৪)

ইতিহাস বলে, পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ শতকে, চীনের শান রাজবংশে। তখন সেখানে বৃদ্ধদের জন্য আরাম-আয়েশ, খাদ্য ও বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এখন বৃদ্ধাশ্রমের চিত্র বদলে গেছে। বর্তমান সমাজে অনেক মা-বাবা দিন কাটান সন্তানদের জন্য অপেক্ষায়, তাদের চোখের পানিতে। তাদের ডাক আর সন্তানের কাছে পৌঁছায় না।

সমাজের এই অমানবিক চিত্র পাল্টাতে হবে। আমাদের সন্তানদের দায়িত্বশীল হতে হবে এবং মা-বাবার প্রতি তাদের কর্তব্য পালন করতে হবে। একজন মায়ের লেখা এই চিঠি যেন আমাদের বিবেককে জাগিয়ে তোলে।


Notice: ob_end_flush(): failed to send buffer of zlib output compression (0) in /home2/checkpostcom/public_html/wp-includes/functions.php on line 5464