চাচার ছায়ায় কোটিপতি রফিকুল: বিআরটিএর শক্তিশালী সিন্ডিকেট নিয়ে নতুন বিস্ফোরক তথ্য
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) উপপরিচালক রফিকুল ইসলাম ওরফে “ভাতিজা রফিক”–এর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে বদলি বাণিজ্য, রেজিস্ট্রেশন জালিয়াতি, ঘুষ-দুর্নীতি এবং দালাল সিন্ডিকেট গড়ে তোলার অভিযোগ উঠেছে। তাঁর কথিত চাচার রাজনৈতিক প্রভাবকে পুঁজি করে তিনি কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ করেছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।
আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীন সময়ে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ দিয়ে রফিকুল ইসলাম বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে পেছন থেকে অর্থায়ন করেছেন বলে জানা গেছে। ২০২৪ সালের ১৪ অক্টোবর এক আদেশে তাঁকে ঢাকা মেট্রো-১ সার্কেল থেকে বরিশাল বিভাগীয় অফিসে বদলি করা হয়। এরও আগে, ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম মেট্রো সার্কেল-১–এ সহকারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সিএনজি অটোরিকশার নতুন রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার নামে উত্তরা মোটরসের ৮টি ডিলারের মাধ্যমে সাধারণ মালিকদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
এ ঘটনায় মন্ত্রণালয়ে তদন্তও শুরু হয়। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিললে তাঁর চাকরি ঝুঁকিতে পড়ে। তবে কথিত চাচা, সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের হস্তক্ষেপে তিনি সেই বিপদ থেকে রক্ষা পান।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বদলির পর রফিকুল ইসলাম বিভিন্ন বদলি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন, মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস–সব ক্ষেত্রেই তিনি দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ঘুষ বাণিজ্য চালিয়ে আসছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকা মেট্রো সার্কেল-১ এ যোগদানের পর মিরপুর-১০ এর শাহাবাস্তি এলাকায় ‘শাহাবাস্তি বিজনেস সেন্টার’ নামের অফিস গড়ে তোলেন। হারুন অর রশিদ ওরফে রুবেলের সঙ্গে মিলিত হয়ে সেখানে একটি শক্তিশালী দালাল সিন্ডিকেট তৈরি করা হয়। এই সিন্ডিকেটের কারণে সাধারণ সেবাপ্রত্যাশীরা দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়ে আসছিলেন।
২০২৪ সালে তিনি সহকারী পরিচালক থেকে উপপরিচালক পদে পদোন্নতি পান। বর্তমানে তিনি বিআরটিএ সদর দপ্তরের উপপরিচালক (অপারেশন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং একই সঙ্গে ঢাকা মেট্রো সার্কেল-৪–এর অতিরিক্ত দায়িত্বেও রয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, অবৈধভাবে অর্জিত অর্থে তিনি আত্মীয়স্বজনের নামে বিপুল সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন। রাজধানীর মগবাজারে আর এম মোটরস (রাইন রাজ্জাক প্লাজা) নামের মোটরসাইকেল শোরুম পরিচালনা করেন তাঁর ছোট ভাই রিয়াজ।
এ ছাড়া মগবাজারেরই আর.এম ইন্টারন্যাশনাল নামের আরেকটি মোটরসাইকেল শোরুম পরিচালনা করেন তাঁর শ্যালক। এই দুই শোরুমও দালাল সিন্ডিকেটের অংশ হিসেবে পরিচালিত হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন রফিকুল ইসলামের বাল্যবন্ধু আসাদ।
২০১৬ সালে ঢাকা জেলা সার্কেলে সহকারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর রফিকুল ইসলাম সিএনজি অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশনের নামে বড় ধরনের অনিয়মমূলক প্রক্রিয়া শুরু করেন। উত্তরা মোটরসের ডিলার খাজি আব্দুর রশিদ বুলু (দ্বীন ইসলাম মোটরস) ও হাজী সুলতানের (সুলতান মোটরস) সহযোগিতায় ঢাকা জেলার নামে হাজারো সিএনজি অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়।
স্বাধীনতার পর কখনোই ঢাকা জেলা থেকে বাণিজ্যিক সিএনজি অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়নি। কিন্তু রফিকুলের সময় একেকটি রেজিস্ট্রেশনের জন্য ন্যূনতম ১ লাখ টাকা করে ঘুষ আদায়ের অভিযোগ ওঠে। ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত তিনি অন্তত ৫ হাজার সিএনজি রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন বলে জানা গেছে।
অধিকাংশ মালিকই ঢাকা জেলার বাসিন্দা নন, বরং ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে ঢাকা মহানগরীর মালিকদের নামে এসব রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়, যা আইনগতভাবে সম্পূর্ণ অবৈধ। এতে রাজধানীতে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয় এবং সিএনজির দামও লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিবহন সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী বলেন, “রফিকুল ইসলামের মতো অসাধু কর্মকর্তাদের শুধু বদলি করলেই হবে না। তাদের সাময়িক বরখাস্ত করে পরিবারের সদস্যদের নামে যেসব অবৈধ সম্পত্তির পাহাড় গড়ে তুলেছে, তার সবগুলোর তদন্ত হওয়া জরুরি। তদন্ত হলেই থলের বিড়াল বের হয়ে আসবে।”
বিআরটিএর মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবাখাতে দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের অনিয়ম, সিন্ডিকেটচক্র ও দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। তবে রফিকুল ইসলামকে ঘিরে ওঠা ধারাবাহিক অভিযোগগুলো আবারও প্রশ্ন তুলছে, কেবল বদলি করলেই কি দুর্নীতি বন্ধ হবে, নাকি প্রয়োজন কঠোর আইনগত ব্যবস্থা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা?











