গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য: গরুর রশি ছেঁড়া প্রতিযোগিতা
আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের গল্প বলতে গেলে যে কিছু খেলাধুলার নাম উঠে আসে, তার মধ্যে গরুর রশি ছেঁড়া প্রতিযোগিতা অন্যতম। নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাওয়া এই খেলা এখনও বাংলার কিছু অঞ্চলে বেঁচে আছে ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে। তেমনই এক আয়োজন দেখা গেল ঢাকার নবাবগঞ্জের যন্ত্রাইল ইউনিয়নের চন্দ্রখোলা ও বিলপল্লী মাঠে।
পৌষ সংক্রান্তি বাঙালির সংস্কৃতিতে এক বিশেষ উৎসবের দিন। গ্রাম বাংলায় এটি কেবল একটি দিনের উৎসব নয়; এটি মিশে থাকে গ্রামের মানুষের আত্মার সাথে। মেলার আয়োজন, পিঠা খাওয়া, ঘুড়ি উড়ানো থেকে শুরু করে গরুর রশি ছেঁড়া প্রতিযোগিতা-সবই থাকে এদিনের বিশেষ আকর্ষণ।
চন্দ্রখোলা কালি মন্দিরের মাঠ এবং বিলপল্লী মাঠে গত ১৪ জানুয়ারি, ২০২৫, বিকেলে অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতা দেখতে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিল। বয়স, পেশা, বা স্থানীয়তা কোনো বাধা নয়; উচ্ছ্বাস নিয়ে সবাই অংশ নিয়েছিল ঐতিহ্যের এই মহাযজ্ঞে।
গরুর রশি ছেঁড়া প্রতিযোগিতা বাংলার এক ঐতিহ্যবাহী খেলা। এটি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে পরিচিত—কোথাও এটি গরু দৌড়, কোথাও রশি ছেঁড়া, আবার কোথাও আড়ং নামে পরিচিত। একসময় দোহার, কেরানীগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায়ও এই খেলা প্রচলিত ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি হারিয়ে যেতে বসেছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, এই মেলা এবং প্রতিযোগিতা বহু বছর ধরে আয়োজন করে আসছে। একে ঘিরে পুরো এলাকা যেন উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। পিঠাপুলির ঘ্রাণে ঘরবাড়ি ভরে যায়, আর অতিথিদের মিলনে যেন গ্রাম বাংলার প্রাণ ফিরে আসে।
চন্দ্রখোলার মাঠে এবারের আয়োজন ছিল চোখ ধাঁধানো। প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষ দলে দলে ভিড় জমায় প্রতিযোগিতা দেখতে। মাঠের চারপাশে তৈরি হয় এক মিলনমেলা। গ্রামীণ মেলায় ওঠে বাঁশের তৈজসপত্র, কাঠের খেলনা, হাতে তৈরি অলংকার, ও বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্টল।
মেলায় মানুষ আসে শুধু প্রতিযোগিতা দেখতেই নয়, বরং ঐতিহ্যকে ছুঁয়ে দেখতে, গ্রামীণ জীবনের সুরে হারিয়ে যেতে। ছোটোদের চোখে ছিল উচ্ছ্বাস, আর বয়স্কদের মনে জাগে স্মৃতিময় দিনের কথা।
নগরায়ণের প্রভাব আর আধুনিক খেলাধুলার প্রসারে হারিয়ে যেতে বসেছে এ ধরনের আয়োজন। কিন্তু চন্দ্রখোলার বাসিন্দারা জানেন এই ঐতিহ্য ধরে রাখার গুরুত্ব। তাই প্রতি বছর তারা এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে তাদের শিকড়ের গল্প।
গরুর রশি ছেঁড়া প্রতিযোগিতা শুধু একটি খেলা নয়; এটি বাংলার মানুষের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের পরিচায়ক। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের গ্রামবাংলার প্রাণবন্ত জীবনের কথা। এই প্রতিযোগিতা শুধু একটি দিন নয়, বরং বাঙালির ঐতিহ্যের এক নিদর্শন, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহমান।
গ্রাম বাংলার এই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে এমন আয়োজন আরও বেশি হওয়া উচিত। শহুরে জীবনে এই আয়োজনগুলো কেবল বিনোদনের নয়, বরং নিজেদের শিকড় খুঁজে পাওয়ারও সুযোগ।