ঢাকা ০৪:১৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ওয়ার্ড নেতার ৩ শতাধিক বাড়ি-ফ্ল্যাট

চেকপোস্ট ডেস্ক::

বিল্লাল উদ্দিন আহমেদের কার্যকলাপ হার মানায় সিনেমার কাহিনিকেও! ছিলেন সামান্য ট্রাকচালক; কিন্তু ‘আওয়ামী লীগের চেরাগ’ হাতে পাওয়ার পর বদলে গেছে তার জীবনের সব দৃশ্যপট—বিত্তবৈভব এবং প্রভাবে গত দেড় যুগে বিল্লাল হয়ে উঠেছেন বেপরোয়া-অপ্রতিরোধ্য। নামে-বেনামে গড়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ, মালিক হয়েছেন তিন শতাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাটের এবং অবশ্যই তা দলীয় প্রভাব খাটিয়ে, অবৈধ উপায়ে। গত দেড় দশকে বিল্লালের মতো আরও অনেক প্রভাবশালী ‘আওয়ামী গডফাদার’ অনৈতিকভাবে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তবে বিস্ময়কর বিষয় হলো, বিল্লাল আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন কোনো পদে বা সরকারি অবস্থানে ছিলেন না কখনো। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ কাজে লাগিয়ে রাজধানীর কাফরুলে অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন বিল্লাল। এমনই দৌরাত্ম্য ছিল তার; মন খারাপ হলেই নিজের খেয়ালখুশিমতো দখল করে নিতেন অন্যের প্লট-ফ্ল্যাট-বাড়ি। বিল্লালের ওয়ার্ডভুক্ত এলাকায় ভবন বানাতে হলে তাকে ফ্ল্যাট দেওয়ার বিষয়টিকে রীতিমতো রেওয়াজে পরিণত করেছিলেন তিনি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বিল্লালের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ নিয়ে মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা।

কে এই বিল্লাল: কাগজে-কলমে নাম বিল্লাল উদ্দিন আহমেদ হলেও কাফরুল এলাকায় দাদা ভাই কিংবা বয়রা বিল্লাল নামেই বেশি পরিচিত তিনি। ঢাকা মহানগর উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন রোকেয়া সরণি, মিরপুর রোড, সেনপাড়া পর্বতা, কাজীপাড়া (পশ্চিম ও পূর্ব) এবং শেওড়াপাড়া (পশ্চিম ও পূর্ব) এলাকা নিয়ে গঠিত ১৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি বিল্লাল। গত ১৫ বছরে এই অঞ্চলের প্রায় সব অপকর্মের নেতৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ ছিল বিল্লালের হাতে। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডই শুধু নয়, পার্শ্ববর্তী পশ্চিম কাফরুল, তালতলা, মোল্লাপাড়া, শাপলা সরণি ও শামীম সরণির বাসিন্দারাও তটস্থ থাকতেন বিল্লালের অত্যাচারে। ক্ষমতার দাপটে প্লট দখল, বাড়ি দখল, ফ্ল্যাট দখল, জুয়ার বোর্ড পরিচালনা, ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজি, বিচার-সালিশের নামে চাঁদাবাজি, সমিতি খুলে সুদের ব্যবসা, জমাকৃত আমানতের টাকা আত্মসাৎ, মাদক কারবার—সব অপরাধেই ছিল তার একচ্ছত্র আধিপত্য। এসব অপকর্ম পরিচালনায় গড়ে তুলেছেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। ‘দাদা বাহিনী’ নামে কুখ্যাত এই চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা।

ট্রাকচালক থেকে আওয়ামী গডফাদার: ২০০০ সালের দিকেও স্থানীয়দের কাছে বিল্লাল পরিচিত ছিলেন ট্রাকচালক হিসেবে। পরে নিজেই ট্রাক কিনে ভাড়া দিতেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিল্লালের ট্রাক ভাড়া নিয়ে রাজধানীর গুলিস্তানে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে বক্তৃতার মঞ্চ বানানো হয়। গ্রেনেড হামলার সময় ওই ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। ওই ঘটনা পুঁজি করেই উত্থান ঘটে বিল্লালের। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিল্লাল প্রচার করতে থাকেন, গ্রেনেড হামলার সময় তিনি আহত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বিল্লালের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে তার জন্মগত বধিরতা! বংশগতভাবেই কানে কম শুনতেন বলে তাকে বয়রা বিল্লাল নামে ডাকতেন অনেকে। কিন্তু গ্রেনেড হামলার কারণে কানে সমস্যা হয়েছে—এমনটি প্রচার চালিয়ে নিজেকে আওয়ামী লীগের নিবেদিত ও নির্যাতিত কর্মী হিসেবে জাহির করতে থাকেন। এই ভুয়া পরিচয়ে বাগিয়ে নেন ১৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ। সেই থেকে আজ অবধি পদ আঁকড়ে আছেন তিনি। আওয়ামী লীগের এই পদ যেন আলাদিনের চেরাগ হয়ে ধরা দিয়েছিল বিল্লালের হাতে। সেই চেরাগ ঘষে বিপুল সম্পদের মালিক বনে গেছেন তিনি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আওয়ামী লীগের শাসনামলে ১৪ নম্বর ওয়ার্ড ও এর আশপাশের এলাকায় অঘোষিতভাবে জারি ছিল বিল্লালের ‘দাদা বাহিনীর’ শাসন। ফুটপাতের দোকান থেকে শুরু করে ভ্যানের সবজিওয়ালা—দাদা বাহিনীকে চাঁদা না দিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ ছিল না কারও। শুরুতে চাঁদাবাজি এবং মাদক কারবার নিয়ে থাকলেও পরবর্তী সময়ে জায়গা-জমি-ফ্ল্যাট দখলে হাত দেন বিল্লাল। তার ওয়ার্ডে কোনো ডেভেলপার কোম্পানি স্থাপনা নির্মাণ করতে চাইলে চাঁদা কিংবা ফ্ল্যাটের মালিকানা দিতে হতো তাকে। এভাবেই শতশত ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন তিনি।

কাফরুল এলাকায় বিতর্কিত হলমার্ক গ্রুপের বেশিরভাগ প্লট দখল করেছে বিল্লালের দাদা বাহিনী। নিজেদের ইচ্ছামতো কোথাও দোকান তুলে ভাড়া দিয়েছেন তারা, কোথাও বসিয়েছেন জুয়ার আসর। জানা যায়, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিল্লালের জুয়ার বোর্ডে অভিযানও চালিয়েছিল। কিন্তু ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের তৎকালীন এক উপকমিশনারের আনুকূল্যে গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন বিল্লাল। কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দেন তার বাহিনীর সদস্যরা। পরে সবকিছু ফেরে আগের অবস্থায়।

দখল করেই তিন শতাধিক ফ্ল্যাটের মালিক: স্থানীয় পর্যায়ে বিল্লালের বিপুল সম্পদের খবর পেয়ে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে নামে। প্রায় ছয় মাস অনুসন্ধান শেষে সম্পদের যে ফিরিস্তি পাওয়া গেছে, তা চোখ কপালে ওঠার মতো! ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এই নেতা রাজধানীতে তিন শতাধিক ফ্ল্যাটের মালিক। শুধু তাই নয়, দুই ডজন বাড়িও রয়েছে তার। বলাই বাহুল্য এসব সম্পদের বেশিরভাগই দখল করা। এ ছাড়াও আছে হাজার হাজার কোটি টাকা মূল্যের নানা সম্পদ। এসবই তিনি গড়েছেন মাত্র দেড় যুগে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিল্লালের ফ্ল্যাট-প্লট ও বাড়ির বেশিরভাগই পশ্চিম কাফরুল, তালতলা, শেওড়াপাড়া ও দক্ষিণ পীরেরবাগ এলাকায়। দক্ষিণ পীরেরবাগ এলাকায় ‘সুতরাং হাউজিং’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে গড়ে উঠেছে ডজনখানেক বহুতল ভবন। এসব ভবনে ফ্ল্যাট রয়েছে ৩ শতাধিক। নথিপত্রে সুতরাং হাউজিংয়ের মালিক বিল্লালসহ তিনজন; কিন্তু নিশ্চিত হওয়া গেছে মালিকানার এক-তৃতীয়াংশ সেখানে গড়েছেন ৩ শতাধিক ফ্ল্যাট, যার মালিকানার বড় অংশই বিল্লালের। তার পক্ষে এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করেন শ্যালক জায়েদ অপু। বিল্লালের অন্যতম সহযোগী এই অপু কো-অপারেটিভ সোসাইটি খুলে সুদের কারবারও চালান। ঋণ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সঞ্চয় হিসেবে টাকা নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

তালতলা এলাকায় বিস্কুট ফ্যাক্টরির মোড়ে গেলেই দেখা যাবে তিনটি বিশালাকৃতির বহুতল ভবনের খোঁজ। এর মধ্যে ১৩৩ নম্বর হোল্ডিংয়ের ভবনটিতেই ফ্ল্যাট রয়েছে ৭২টি। ভবনের অর্ধেকের বেশি শেয়ার বিল্লালের নামে। এর পাশে প্রায় সমান আকৃতির অন্য দুটি ভবনেও রয়েছে বিল্লালের অংশীদারত্ব। এর মধ্যে একটি ভবনের মালিকানায় নাম রয়েছে বুলবুল মাস্টারের। তিনি বিল্লালের কন্সট্রাকশনের সাইটের দেখাশোনা করেন বলে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা এবং এসব ভবনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্মীরা।

তালতলা কেন্দ্রীয় মসজিদ রোডে এল ডোরাডো হোল্ডিংস নামে আবাসন কোম্পানির ভবনেও মালিকানা আছে বিল্লালের। পশ্চিম কাফরুলের ১২৭ নম্বর হোল্ডিংয়ের মুসা টাওয়ারে মিলিছে তার চারটি ফ্ল্যাটের সন্ধান। একটু সামনে এগোলেই ২২৪ নম্বর প্লটের মালিকও বিল্লাল। সেখানে গোটা দশেক দোকান তুলে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এই সড়কের মাথায় ১৯০ পশ্চিম কাফরুলে বিল্লালে আরেকটি প্লটে আগে জুয়ার বোর্ড বসানো ছিল, এখন সেখানেও দোকান তোলা হয়েছে। এই মোড় থেকে ডানে এগোলে বাঁপাশে আরও একটি প্লটে ৫ আগস্টের আগেও জুয়ার বোর্ড বসানো হতো।

পূর্ব কাফরুলের তিন রাস্তা মোড়ে ১৮৯ নম্বর প্লটে সাততলা আরেকটি ভবন আছে বিল্লালের। মোল্লাপাড়া মোড়ে চলছে তার আরেকটি ভবনের নির্মাণকাজ। পশ্চিম শেওরাপাড়ার ৫৩১ হোল্ডিংয়ের ‘এজাব রোস ভ্যালি’ নামের ভবনেও অন্তত চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে বিল্লালের। পশ্চিম কাফরুলের ১৭১/১/ই/১ নম্বর হোল্ডিংয়ে মাতৃছায়া নামের ভবনেও ফ্ল্যাট আছে তার। একই এলাকার ১৬৭/এ বিলকিস কটেজ, ১৬৭/বি১ বন্ধন টাওয়ার, ১৭৩ নম্বর হোল্ডিং এবং তালতলার ‘স্বপ্নকুঞ্জ’ নামের ভবনেও বিল্লালের ফ্ল্যাটের খোঁজ মিলেছে। পশ্চিম কাফরুলের ৩৫, ৩৫/এ, ২৮/২, ২৮/১, ২৮/৩ হোল্ডিংয়ের বাসাগুলোতেও ফ্ল্যাট ও মালিকানার শেয়ার রয়েছে আওয়ামী লীগের এই নেতার। এ ছাড়া মোল্লাপাড়া, মুক্তি হাউজিং, সুতরাং হাউজিং, দক্ষিণ পীরেরবাগ এলাকায় নামে-বেনামে তিনি অসংখ্য ফ্ল্যাটের মালিক বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা জানান, এসব ফ্ল্যাটের বেশিরভাগই বিল্লাল দখল করেছেন। বাড়ি বানানোর সময় বিল্লালকে ফ্ল্যাটের মালিকানা না দিলে নিজের বাহিনী পাঠিয়ে কাজ বন্ধ করে দিতেন তিনি। কেউ প্রতিবাদ করলে চালানো হতো নির্যাতন। প্রশাসনের দারস্থ হয়েও লাভ হয়নি কারও। ফলে বাড়ির মালিক কিংবা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফ্ল্যাটের দলিল বিল্লালকে দিতে বাধ্য হতেন।
তালতলার ২২৪/১ নম্বর হোল্ডিংয়ে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের অফিসটিও বিল্লাল নির্মাণ করেছেন দখলকৃত জায়গায়। এখন সেখানে দোকান বানিয়ে ভাড়া দিয়েছেন।

বিল্লালের আট ‘খলিফা’: বিল্লালের অপরাধের সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলেন আটজন। তারা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা বিষয় দেখভাল করতেন। শ্যালক অপু নিয়ন্ত্রণ করতেন সুদের করবার। কনস্ট্রাকশন সাইট ও ফ্ল্যাট, বাড়ি, প্লট দেখভালের জন্য বুলবুল মাস্টারের সঙ্গে ছিলেন হালিম আকন্দ নামে আরেকজন। জুয়ার বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন হাসু-কাসু নামে দুই ভাই। পশ্চিম কাফরুল, তালতলা, শেওড়াপাড়া, মোল্লাপাড়া, শাপলা সরণি, শামীম সরণি, সুতরাং হাউজিং, মুক্তি হাউজিং এলাকার মাদকের কারবার সমন্বয় করতেন কাসেম। মসজিদ গলি ও তালতলা বাসস্ট্যান্ডে এলাকায় ফুটপাতে দোকান এবং ভ্যানগাড়ি থেকে বিল্লালের নামে চাঁদা তুলতেন রাসেল ও জাহাঙ্গীর নামে দুই ব্যক্তি। বিল্লালের ছত্রছায়ায় এরা প্রত্যেকেই গড়েছেন বিপুল সম্পদ।

যা বলছেন বিল্লাল: বিপুল সম্পদ এবং দলীয় প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ আয়ের বিষয়ে অনুসন্ধান চলার সময় তার বক্তব্য জানার চেষ্টা করে। দুই মাস আগে তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়েছে। সেসময় তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করে নিজের বক্তব্য জানানোর আশ্বাস দেন; কিন্তু ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বিল্লাল গা-ঢাকা দেওয়ায় তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তালতলা এলাকায় তার বাসা ও অফিসে একাধিকবার গিয়েও যোগাযোগ করা যায়নি তার সঙ্গে। প্রশ্ন লিখে তার মোবাইল ফোন নম্বরে মেসেজ পাঠালেও উত্তর মেলেনি। তার শ্যালক জায়েদ অপুকে বারবার ফোন দিয়ে এবং মেসেজ পাঠিয়েও অভিযোগের বিষয়ে বিল্লালের বক্তব্য মেলেনি।

ট্যাগস :

নিউজটি টাইম লাইনে শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

চেকপোস্ট

Checkpost is one of the most popular Bengali news portal and print newspaper in Bangladesh. The print and online news portal started its operations with a commitment to fearless, investigative, informative and unbiased journalism.
আপডেট সময় ১০:০৮:১৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪
৫০৯ বার পড়া হয়েছে

ওয়ার্ড নেতার ৩ শতাধিক বাড়ি-ফ্ল্যাট

আপডেট সময় ১০:০৮:১৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪

বিল্লাল উদ্দিন আহমেদের কার্যকলাপ হার মানায় সিনেমার কাহিনিকেও! ছিলেন সামান্য ট্রাকচালক; কিন্তু ‘আওয়ামী লীগের চেরাগ’ হাতে পাওয়ার পর বদলে গেছে তার জীবনের সব দৃশ্যপট—বিত্তবৈভব এবং প্রভাবে গত দেড় যুগে বিল্লাল হয়ে উঠেছেন বেপরোয়া-অপ্রতিরোধ্য। নামে-বেনামে গড়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ, মালিক হয়েছেন তিন শতাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাটের এবং অবশ্যই তা দলীয় প্রভাব খাটিয়ে, অবৈধ উপায়ে। গত দেড় দশকে বিল্লালের মতো আরও অনেক প্রভাবশালী ‘আওয়ামী গডফাদার’ অনৈতিকভাবে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তবে বিস্ময়কর বিষয় হলো, বিল্লাল আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন কোনো পদে বা সরকারি অবস্থানে ছিলেন না কখনো। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ কাজে লাগিয়ে রাজধানীর কাফরুলে অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন বিল্লাল। এমনই দৌরাত্ম্য ছিল তার; মন খারাপ হলেই নিজের খেয়ালখুশিমতো দখল করে নিতেন অন্যের প্লট-ফ্ল্যাট-বাড়ি। বিল্লালের ওয়ার্ডভুক্ত এলাকায় ভবন বানাতে হলে তাকে ফ্ল্যাট দেওয়ার বিষয়টিকে রীতিমতো রেওয়াজে পরিণত করেছিলেন তিনি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বিল্লালের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ নিয়ে মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা।

কে এই বিল্লাল: কাগজে-কলমে নাম বিল্লাল উদ্দিন আহমেদ হলেও কাফরুল এলাকায় দাদা ভাই কিংবা বয়রা বিল্লাল নামেই বেশি পরিচিত তিনি। ঢাকা মহানগর উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন রোকেয়া সরণি, মিরপুর রোড, সেনপাড়া পর্বতা, কাজীপাড়া (পশ্চিম ও পূর্ব) এবং শেওড়াপাড়া (পশ্চিম ও পূর্ব) এলাকা নিয়ে গঠিত ১৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি বিল্লাল। গত ১৫ বছরে এই অঞ্চলের প্রায় সব অপকর্মের নেতৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ ছিল বিল্লালের হাতে। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডই শুধু নয়, পার্শ্ববর্তী পশ্চিম কাফরুল, তালতলা, মোল্লাপাড়া, শাপলা সরণি ও শামীম সরণির বাসিন্দারাও তটস্থ থাকতেন বিল্লালের অত্যাচারে। ক্ষমতার দাপটে প্লট দখল, বাড়ি দখল, ফ্ল্যাট দখল, জুয়ার বোর্ড পরিচালনা, ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজি, বিচার-সালিশের নামে চাঁদাবাজি, সমিতি খুলে সুদের ব্যবসা, জমাকৃত আমানতের টাকা আত্মসাৎ, মাদক কারবার—সব অপরাধেই ছিল তার একচ্ছত্র আধিপত্য। এসব অপকর্ম পরিচালনায় গড়ে তুলেছেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। ‘দাদা বাহিনী’ নামে কুখ্যাত এই চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা।

ট্রাকচালক থেকে আওয়ামী গডফাদার: ২০০০ সালের দিকেও স্থানীয়দের কাছে বিল্লাল পরিচিত ছিলেন ট্রাকচালক হিসেবে। পরে নিজেই ট্রাক কিনে ভাড়া দিতেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিল্লালের ট্রাক ভাড়া নিয়ে রাজধানীর গুলিস্তানে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে বক্তৃতার মঞ্চ বানানো হয়। গ্রেনেড হামলার সময় ওই ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। ওই ঘটনা পুঁজি করেই উত্থান ঘটে বিল্লালের। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিল্লাল প্রচার করতে থাকেন, গ্রেনেড হামলার সময় তিনি আহত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বিল্লালের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে তার জন্মগত বধিরতা! বংশগতভাবেই কানে কম শুনতেন বলে তাকে বয়রা বিল্লাল নামে ডাকতেন অনেকে। কিন্তু গ্রেনেড হামলার কারণে কানে সমস্যা হয়েছে—এমনটি প্রচার চালিয়ে নিজেকে আওয়ামী লীগের নিবেদিত ও নির্যাতিত কর্মী হিসেবে জাহির করতে থাকেন। এই ভুয়া পরিচয়ে বাগিয়ে নেন ১৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ। সেই থেকে আজ অবধি পদ আঁকড়ে আছেন তিনি। আওয়ামী লীগের এই পদ যেন আলাদিনের চেরাগ হয়ে ধরা দিয়েছিল বিল্লালের হাতে। সেই চেরাগ ঘষে বিপুল সম্পদের মালিক বনে গেছেন তিনি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আওয়ামী লীগের শাসনামলে ১৪ নম্বর ওয়ার্ড ও এর আশপাশের এলাকায় অঘোষিতভাবে জারি ছিল বিল্লালের ‘দাদা বাহিনীর’ শাসন। ফুটপাতের দোকান থেকে শুরু করে ভ্যানের সবজিওয়ালা—দাদা বাহিনীকে চাঁদা না দিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ ছিল না কারও। শুরুতে চাঁদাবাজি এবং মাদক কারবার নিয়ে থাকলেও পরবর্তী সময়ে জায়গা-জমি-ফ্ল্যাট দখলে হাত দেন বিল্লাল। তার ওয়ার্ডে কোনো ডেভেলপার কোম্পানি স্থাপনা নির্মাণ করতে চাইলে চাঁদা কিংবা ফ্ল্যাটের মালিকানা দিতে হতো তাকে। এভাবেই শতশত ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন তিনি।

কাফরুল এলাকায় বিতর্কিত হলমার্ক গ্রুপের বেশিরভাগ প্লট দখল করেছে বিল্লালের দাদা বাহিনী। নিজেদের ইচ্ছামতো কোথাও দোকান তুলে ভাড়া দিয়েছেন তারা, কোথাও বসিয়েছেন জুয়ার আসর। জানা যায়, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিল্লালের জুয়ার বোর্ডে অভিযানও চালিয়েছিল। কিন্তু ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের তৎকালীন এক উপকমিশনারের আনুকূল্যে গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন বিল্লাল। কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দেন তার বাহিনীর সদস্যরা। পরে সবকিছু ফেরে আগের অবস্থায়।

দখল করেই তিন শতাধিক ফ্ল্যাটের মালিক: স্থানীয় পর্যায়ে বিল্লালের বিপুল সম্পদের খবর পেয়ে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে নামে। প্রায় ছয় মাস অনুসন্ধান শেষে সম্পদের যে ফিরিস্তি পাওয়া গেছে, তা চোখ কপালে ওঠার মতো! ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এই নেতা রাজধানীতে তিন শতাধিক ফ্ল্যাটের মালিক। শুধু তাই নয়, দুই ডজন বাড়িও রয়েছে তার। বলাই বাহুল্য এসব সম্পদের বেশিরভাগই দখল করা। এ ছাড়াও আছে হাজার হাজার কোটি টাকা মূল্যের নানা সম্পদ। এসবই তিনি গড়েছেন মাত্র দেড় যুগে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিল্লালের ফ্ল্যাট-প্লট ও বাড়ির বেশিরভাগই পশ্চিম কাফরুল, তালতলা, শেওড়াপাড়া ও দক্ষিণ পীরেরবাগ এলাকায়। দক্ষিণ পীরেরবাগ এলাকায় ‘সুতরাং হাউজিং’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে গড়ে উঠেছে ডজনখানেক বহুতল ভবন। এসব ভবনে ফ্ল্যাট রয়েছে ৩ শতাধিক। নথিপত্রে সুতরাং হাউজিংয়ের মালিক বিল্লালসহ তিনজন; কিন্তু নিশ্চিত হওয়া গেছে মালিকানার এক-তৃতীয়াংশ সেখানে গড়েছেন ৩ শতাধিক ফ্ল্যাট, যার মালিকানার বড় অংশই বিল্লালের। তার পক্ষে এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করেন শ্যালক জায়েদ অপু। বিল্লালের অন্যতম সহযোগী এই অপু কো-অপারেটিভ সোসাইটি খুলে সুদের কারবারও চালান। ঋণ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সঞ্চয় হিসেবে টাকা নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

তালতলা এলাকায় বিস্কুট ফ্যাক্টরির মোড়ে গেলেই দেখা যাবে তিনটি বিশালাকৃতির বহুতল ভবনের খোঁজ। এর মধ্যে ১৩৩ নম্বর হোল্ডিংয়ের ভবনটিতেই ফ্ল্যাট রয়েছে ৭২টি। ভবনের অর্ধেকের বেশি শেয়ার বিল্লালের নামে। এর পাশে প্রায় সমান আকৃতির অন্য দুটি ভবনেও রয়েছে বিল্লালের অংশীদারত্ব। এর মধ্যে একটি ভবনের মালিকানায় নাম রয়েছে বুলবুল মাস্টারের। তিনি বিল্লালের কন্সট্রাকশনের সাইটের দেখাশোনা করেন বলে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা এবং এসব ভবনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্মীরা।

তালতলা কেন্দ্রীয় মসজিদ রোডে এল ডোরাডো হোল্ডিংস নামে আবাসন কোম্পানির ভবনেও মালিকানা আছে বিল্লালের। পশ্চিম কাফরুলের ১২৭ নম্বর হোল্ডিংয়ের মুসা টাওয়ারে মিলিছে তার চারটি ফ্ল্যাটের সন্ধান। একটু সামনে এগোলেই ২২৪ নম্বর প্লটের মালিকও বিল্লাল। সেখানে গোটা দশেক দোকান তুলে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এই সড়কের মাথায় ১৯০ পশ্চিম কাফরুলে বিল্লালে আরেকটি প্লটে আগে জুয়ার বোর্ড বসানো ছিল, এখন সেখানেও দোকান তোলা হয়েছে। এই মোড় থেকে ডানে এগোলে বাঁপাশে আরও একটি প্লটে ৫ আগস্টের আগেও জুয়ার বোর্ড বসানো হতো।

পূর্ব কাফরুলের তিন রাস্তা মোড়ে ১৮৯ নম্বর প্লটে সাততলা আরেকটি ভবন আছে বিল্লালের। মোল্লাপাড়া মোড়ে চলছে তার আরেকটি ভবনের নির্মাণকাজ। পশ্চিম শেওরাপাড়ার ৫৩১ হোল্ডিংয়ের ‘এজাব রোস ভ্যালি’ নামের ভবনেও অন্তত চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে বিল্লালের। পশ্চিম কাফরুলের ১৭১/১/ই/১ নম্বর হোল্ডিংয়ে মাতৃছায়া নামের ভবনেও ফ্ল্যাট আছে তার। একই এলাকার ১৬৭/এ বিলকিস কটেজ, ১৬৭/বি১ বন্ধন টাওয়ার, ১৭৩ নম্বর হোল্ডিং এবং তালতলার ‘স্বপ্নকুঞ্জ’ নামের ভবনেও বিল্লালের ফ্ল্যাটের খোঁজ মিলেছে। পশ্চিম কাফরুলের ৩৫, ৩৫/এ, ২৮/২, ২৮/১, ২৮/৩ হোল্ডিংয়ের বাসাগুলোতেও ফ্ল্যাট ও মালিকানার শেয়ার রয়েছে আওয়ামী লীগের এই নেতার। এ ছাড়া মোল্লাপাড়া, মুক্তি হাউজিং, সুতরাং হাউজিং, দক্ষিণ পীরেরবাগ এলাকায় নামে-বেনামে তিনি অসংখ্য ফ্ল্যাটের মালিক বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা জানান, এসব ফ্ল্যাটের বেশিরভাগই বিল্লাল দখল করেছেন। বাড়ি বানানোর সময় বিল্লালকে ফ্ল্যাটের মালিকানা না দিলে নিজের বাহিনী পাঠিয়ে কাজ বন্ধ করে দিতেন তিনি। কেউ প্রতিবাদ করলে চালানো হতো নির্যাতন। প্রশাসনের দারস্থ হয়েও লাভ হয়নি কারও। ফলে বাড়ির মালিক কিংবা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফ্ল্যাটের দলিল বিল্লালকে দিতে বাধ্য হতেন।
তালতলার ২২৪/১ নম্বর হোল্ডিংয়ে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের অফিসটিও বিল্লাল নির্মাণ করেছেন দখলকৃত জায়গায়। এখন সেখানে দোকান বানিয়ে ভাড়া দিয়েছেন।

বিল্লালের আট ‘খলিফা’: বিল্লালের অপরাধের সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলেন আটজন। তারা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা বিষয় দেখভাল করতেন। শ্যালক অপু নিয়ন্ত্রণ করতেন সুদের করবার। কনস্ট্রাকশন সাইট ও ফ্ল্যাট, বাড়ি, প্লট দেখভালের জন্য বুলবুল মাস্টারের সঙ্গে ছিলেন হালিম আকন্দ নামে আরেকজন। জুয়ার বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন হাসু-কাসু নামে দুই ভাই। পশ্চিম কাফরুল, তালতলা, শেওড়াপাড়া, মোল্লাপাড়া, শাপলা সরণি, শামীম সরণি, সুতরাং হাউজিং, মুক্তি হাউজিং এলাকার মাদকের কারবার সমন্বয় করতেন কাসেম। মসজিদ গলি ও তালতলা বাসস্ট্যান্ডে এলাকায় ফুটপাতে দোকান এবং ভ্যানগাড়ি থেকে বিল্লালের নামে চাঁদা তুলতেন রাসেল ও জাহাঙ্গীর নামে দুই ব্যক্তি। বিল্লালের ছত্রছায়ায় এরা প্রত্যেকেই গড়েছেন বিপুল সম্পদ।

যা বলছেন বিল্লাল: বিপুল সম্পদ এবং দলীয় প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ আয়ের বিষয়ে অনুসন্ধান চলার সময় তার বক্তব্য জানার চেষ্টা করে। দুই মাস আগে তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়েছে। সেসময় তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করে নিজের বক্তব্য জানানোর আশ্বাস দেন; কিন্তু ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বিল্লাল গা-ঢাকা দেওয়ায় তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তালতলা এলাকায় তার বাসা ও অফিসে একাধিকবার গিয়েও যোগাযোগ করা যায়নি তার সঙ্গে। প্রশ্ন লিখে তার মোবাইল ফোন নম্বরে মেসেজ পাঠালেও উত্তর মেলেনি। তার শ্যালক জায়েদ অপুকে বারবার ফোন দিয়ে এবং মেসেজ পাঠিয়েও অভিযোগের বিষয়ে বিল্লালের বক্তব্য মেলেনি।