ঢাকা ০৫:১৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আদালতপাড়ায় উদ্বিগ্ন স্বজনদের আহাজারি

চেকপোস্ট ডেস্ক::

চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শ্রমিক, দিনমজুর, ব্যবসায়ীদেরও যেতে হচ্ছে কারাগারে। রাজধানীতে সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর, সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় রোববার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় আরও ২২৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ নিয়ে রাজধানীতে ২২৯ মামলায় মোট গ্রেফতার ২ হাজার ৭৬৪ জন।

রোববার সরেজমিন ঢাকার আদালত ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে চলছে স্বজনদের আহাজারি। আদালতে একেকটি প্রিজন ভ্যান আসছে আর তাতে আপনজনের খোঁজে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন উদ্বিগ্ন স্বজনরা। তাদের কেউ ভাই, কেউ সন্তান, কেউ বাবা আর কেউ বা স্বামীর সন্ধানে ভোরের আলো না ফুটতেই এসেছেন আদালতে। গেল কয়েকদিনের ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’ জড়িত সন্দেহে পুলিশ ও ডিবি পুলিশ তাদের স্বজনদের গ্রেফতার করেছে।

শারমিন আক্তার স্বর্ণা মা ও ১০ বছরের ছোট ভাই জোনায়েদকে নিয়ে আদালতে এসেছেন তার বাবার জন্য। শনিবার বিকালে বাজার করে বাসায় ফেরার সময় তার বাবা আক্তার হোসেনকে আটক করেছে পল্লবী থানা পুলিশ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমার বাবা গার্মেন্টসের ব্যবসা করেন। গত শনিবার বাজার করে বাসায় ফেরার সময় বাবাকে পুলিশ ধরেছে। আমাদের পরিবারের একমাত্র গার্ডিয়ান আমার বাবা। আমাদের এভাবে হয়রানি করার মানে কী বুঝতে পারছি না। সাধারণ মানুষকে কেন এভাবে হয়রানি করা হচ্ছে? পাশেই অঝোরে কাঁদছিলেন আক্তার হোসেনের স্ত্রী। তিনি বলেন, আমার স্বামীর বয়স ৫০ বছর। তিনি তো কোনো কিছুতে যাননি। তাকে ধরে নিয়ে এসেছে। এখন আমার পরিবারের কী হবে, কে দেখবে আমাদের?

ঢাকা পলিটেকনিকের ইন্টার্ন শিক্ষার্থী সাদ্দাম হোসেন শনিবার কলেজের হলে এসেছিলেন নিজের বই, খাতা ও শিট নেওয়ার জন্য। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তখন তাকে আটকে রাখে। দীর্ঘ ৩-৪ ঘণ্টা নির্যাতনের পর তারা তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পরে পুলিশ তাকে মোটরসাইকেল পোড়ানো, মারধর, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের মামলায় গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়। সাদ্দামের ভাই হানিফ বলেন, আমার ছোট ভাই গাজীপুরে আমার কাছেই থাকত। ক্যাম্পাস বন্ধ হওয়ার পরই ও বাসায় চলে যায়। গতকাল বই, খাতা, শিট আনার জন্য ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগের বড় ভাইদের ফোন দেয়। তারা ওকে যেতে বলে। ক্যাম্পাসে যাওয়ার পর ওকে রুমে আটকে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা মারধর করেছে। ও এখন স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারছে না। মারধরের পর ওরা আমার ভাইকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। আমার ভাই সাধারণ শিক্ষার্থী। সে কোনো ঝামেলায় কখনো যায়নি।

পিকআপচালক রনির স্ত্রী আলো আক্তার ৬ মাসের সন্তানকে নিয়ে ঘুরছেন আদালতের সামনে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমার স্বামী পিকআপ চালায়। ঘরে বাজার না থাকায় বের হয়েছিলেন খাবার কিনতে। এরপর জানতে পারি তাকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। তাকে ছাড়ানোর জন্য পুলিশকে টাকা দিলেও তারা রনিকে ছাড়েনি।

শারীরিক প্রতিবন্ধী ভাইয়ের একমাত্র ছেলে মো. শিহাবকে একনজর দেখার জন্য গাড়দের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন নির্মাণ শ্রমিক মো. রমজান। ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল এলাকায় বাজার করতে বের হয়েছিল তার ভাতিজা শিহাব। সেখানে ধাওয়া-পালটাধাওয়ার মাঝে পড়ে তিনি পিঠে গুলিবিদ্ধ হন। স্থানীয়রা শিহাবকে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। এরপর ২৪ জুলাই হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিলে শাহবাগ থানার মামলায় শিহাবকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আগে থেকেই তাকে নজরবন্দি করে রাখা হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন রমজান। রমজান যুগান্তরকে বলেন, শিহাবের বয়স যখন ছয় বছর তখন ওর মা মারা যায়, ওর বাবা শারীরিক প্রতিবন্ধী। ওকে আমরা বড় করেছি। ও যদি মিছিলে গিয়ে গ্রেফতার হতো, তাও সান্ত্বনা দিতে পারতাম। কিন্তু ও তো ইন্টারে পড়ে, কোটা আন্দোলনেও যায়নি। বাজার করতে গিয়ে গুলি খেল, আবার এখন পুলিশ গ্রেফতারও করল।

সাভার থেকে এসেছেন গার্মেন্টকর্মী সবুরা বেগম। সহিংসতার ঘটনায় সাভারের একটি মেস থেকে সবুরার ছেলে শরবত বিক্রেতা সাব্বির ও মেয়ের জামাই গার্মেন্টকর্মী আনিসকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সবুরা যুগান্তরকে জানান, ছেলে সাব্বির ও মেয়ের জামাই আনিস সাভারের নিউমার্কেট এলাকার একটি মেসে ভাড়া থাকতেন। সাব্বির রাস্তায় শরবত বিক্রি করত। আর আনিস একটি গার্মেন্টসে কাজ করতেন। পুলিশ বিনা অপরাধে তাদের গ্রেফতার করেছে। আমি গরিব মানুষ, তাদের ছাড়ানোর মতো টাকা-পয়সাও নেই আমার।

শুধু স্বর্ণা, হানিফ বা আলো আক্তারই নন, এমন শত শত স্বজনের আহাজারিতে প্রতিদিনই ভারী হয়ে উঠছে আদালতপাড়া। কমপক্ষে ১৫ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে এই প্রতিবেদক কথা বলেছেন। এর মধ্যে ছাত্রদের পাশাপাশি মাঝবয়সি, ব্যবসায়ী, শ্রমিকও রয়েছেন। যাদের সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এদের সবাইকেই ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি নাশকতার মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের এক নজর দেখতে এবং আইনি প্রক্রিয়ায় ছাড়িয়ে নিতে আদালতপাড়ায় চলছে স্বজনদের এই আহাজারি।

 

ট্যাগস :

নিউজটি টাইম লাইনে শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

চেকপোস্ট

Checkpost is one of the most popular Bengali news portal and print newspaper in Bangladesh. The print and online news portal started its operations with a commitment to fearless, investigative, informative and unbiased journalism.
আপডেট সময় ১১:২৬:৩৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৯ জুলাই ২০২৪
৫০৬ বার পড়া হয়েছে

আদালতপাড়ায় উদ্বিগ্ন স্বজনদের আহাজারি

আপডেট সময় ১১:২৬:৩৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৯ জুলাই ২০২৪

চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শ্রমিক, দিনমজুর, ব্যবসায়ীদেরও যেতে হচ্ছে কারাগারে। রাজধানীতে সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর, সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় রোববার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় আরও ২২৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ নিয়ে রাজধানীতে ২২৯ মামলায় মোট গ্রেফতার ২ হাজার ৭৬৪ জন।

রোববার সরেজমিন ঢাকার আদালত ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে চলছে স্বজনদের আহাজারি। আদালতে একেকটি প্রিজন ভ্যান আসছে আর তাতে আপনজনের খোঁজে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন উদ্বিগ্ন স্বজনরা। তাদের কেউ ভাই, কেউ সন্তান, কেউ বাবা আর কেউ বা স্বামীর সন্ধানে ভোরের আলো না ফুটতেই এসেছেন আদালতে। গেল কয়েকদিনের ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’ জড়িত সন্দেহে পুলিশ ও ডিবি পুলিশ তাদের স্বজনদের গ্রেফতার করেছে।

শারমিন আক্তার স্বর্ণা মা ও ১০ বছরের ছোট ভাই জোনায়েদকে নিয়ে আদালতে এসেছেন তার বাবার জন্য। শনিবার বিকালে বাজার করে বাসায় ফেরার সময় তার বাবা আক্তার হোসেনকে আটক করেছে পল্লবী থানা পুলিশ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমার বাবা গার্মেন্টসের ব্যবসা করেন। গত শনিবার বাজার করে বাসায় ফেরার সময় বাবাকে পুলিশ ধরেছে। আমাদের পরিবারের একমাত্র গার্ডিয়ান আমার বাবা। আমাদের এভাবে হয়রানি করার মানে কী বুঝতে পারছি না। সাধারণ মানুষকে কেন এভাবে হয়রানি করা হচ্ছে? পাশেই অঝোরে কাঁদছিলেন আক্তার হোসেনের স্ত্রী। তিনি বলেন, আমার স্বামীর বয়স ৫০ বছর। তিনি তো কোনো কিছুতে যাননি। তাকে ধরে নিয়ে এসেছে। এখন আমার পরিবারের কী হবে, কে দেখবে আমাদের?

ঢাকা পলিটেকনিকের ইন্টার্ন শিক্ষার্থী সাদ্দাম হোসেন শনিবার কলেজের হলে এসেছিলেন নিজের বই, খাতা ও শিট নেওয়ার জন্য। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তখন তাকে আটকে রাখে। দীর্ঘ ৩-৪ ঘণ্টা নির্যাতনের পর তারা তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পরে পুলিশ তাকে মোটরসাইকেল পোড়ানো, মারধর, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের মামলায় গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়। সাদ্দামের ভাই হানিফ বলেন, আমার ছোট ভাই গাজীপুরে আমার কাছেই থাকত। ক্যাম্পাস বন্ধ হওয়ার পরই ও বাসায় চলে যায়। গতকাল বই, খাতা, শিট আনার জন্য ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগের বড় ভাইদের ফোন দেয়। তারা ওকে যেতে বলে। ক্যাম্পাসে যাওয়ার পর ওকে রুমে আটকে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা মারধর করেছে। ও এখন স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারছে না। মারধরের পর ওরা আমার ভাইকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। আমার ভাই সাধারণ শিক্ষার্থী। সে কোনো ঝামেলায় কখনো যায়নি।

পিকআপচালক রনির স্ত্রী আলো আক্তার ৬ মাসের সন্তানকে নিয়ে ঘুরছেন আদালতের সামনে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমার স্বামী পিকআপ চালায়। ঘরে বাজার না থাকায় বের হয়েছিলেন খাবার কিনতে। এরপর জানতে পারি তাকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। তাকে ছাড়ানোর জন্য পুলিশকে টাকা দিলেও তারা রনিকে ছাড়েনি।

শারীরিক প্রতিবন্ধী ভাইয়ের একমাত্র ছেলে মো. শিহাবকে একনজর দেখার জন্য গাড়দের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন নির্মাণ শ্রমিক মো. রমজান। ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল এলাকায় বাজার করতে বের হয়েছিল তার ভাতিজা শিহাব। সেখানে ধাওয়া-পালটাধাওয়ার মাঝে পড়ে তিনি পিঠে গুলিবিদ্ধ হন। স্থানীয়রা শিহাবকে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। এরপর ২৪ জুলাই হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিলে শাহবাগ থানার মামলায় শিহাবকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আগে থেকেই তাকে নজরবন্দি করে রাখা হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন রমজান। রমজান যুগান্তরকে বলেন, শিহাবের বয়স যখন ছয় বছর তখন ওর মা মারা যায়, ওর বাবা শারীরিক প্রতিবন্ধী। ওকে আমরা বড় করেছি। ও যদি মিছিলে গিয়ে গ্রেফতার হতো, তাও সান্ত্বনা দিতে পারতাম। কিন্তু ও তো ইন্টারে পড়ে, কোটা আন্দোলনেও যায়নি। বাজার করতে গিয়ে গুলি খেল, আবার এখন পুলিশ গ্রেফতারও করল।

সাভার থেকে এসেছেন গার্মেন্টকর্মী সবুরা বেগম। সহিংসতার ঘটনায় সাভারের একটি মেস থেকে সবুরার ছেলে শরবত বিক্রেতা সাব্বির ও মেয়ের জামাই গার্মেন্টকর্মী আনিসকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সবুরা যুগান্তরকে জানান, ছেলে সাব্বির ও মেয়ের জামাই আনিস সাভারের নিউমার্কেট এলাকার একটি মেসে ভাড়া থাকতেন। সাব্বির রাস্তায় শরবত বিক্রি করত। আর আনিস একটি গার্মেন্টসে কাজ করতেন। পুলিশ বিনা অপরাধে তাদের গ্রেফতার করেছে। আমি গরিব মানুষ, তাদের ছাড়ানোর মতো টাকা-পয়সাও নেই আমার।

শুধু স্বর্ণা, হানিফ বা আলো আক্তারই নন, এমন শত শত স্বজনের আহাজারিতে প্রতিদিনই ভারী হয়ে উঠছে আদালতপাড়া। কমপক্ষে ১৫ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে এই প্রতিবেদক কথা বলেছেন। এর মধ্যে ছাত্রদের পাশাপাশি মাঝবয়সি, ব্যবসায়ী, শ্রমিকও রয়েছেন। যাদের সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এদের সবাইকেই ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি নাশকতার মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের এক নজর দেখতে এবং আইনি প্রক্রিয়ায় ছাড়িয়ে নিতে আদালতপাড়ায় চলছে স্বজনদের এই আহাজারি।